সৌভাগ্যের অর্থ ও প্রকৃতি

সৌভাগ্যের অর্থ ও প্রকৃতি

সৌভাগ্যের অর্থ ও প্রকৃতি

সুখের অর্থ

$Roger_Du_Pasquier.jpg*

রোজীহ ডুবাকীহ

সুইস চিন্তাবিদ ও সাংবাদিক
সুখ ও প্রশান্তির ধর্ম
“আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিঃ মুসলমানেরা দরিদ্রতা ও অনুন্নতি সত্বেও কেন এতো সুখ অনুভব করে?! সুইডিশরা প্রশস্ত, আয়েশী ও উন্নত জীবন যাপনের পরেও কেন এতো দুঃখ দুর্দশা ভোগ করে? এমনকি আমার দেশ সুইজারল্যান্ডেও একই ধরণের অনুভূতি অনুভব করি যেমনটি করেছি সুইডেনে, অথচ এ দেশগুলো হলো সমৃদ্ধিশালী ও জীবন যাপনের মান খুবই উন্নত। এ সব কিছুর ফলে আমি প্রাচ্যের ধর্মসমুহ নিয়ে পড়াশুনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। প্রথমে হিন্দু ধর্ম নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করি। কিন্তু আমি এতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। পরে ইসলাম ধর্ম নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করি। আমি লক্ষ্য করলাম এ ধর্ম অন্যান্য ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং ইহা সব ধর্মকে ব্যাপ্তি করে। ইহা সর্বশেষ ধর্ম। আমি ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করার ফলে এ বাস্তবতা আমার কাছে আরো বিস্তার লাভ করে এবং ইহা আমার অন্তরে দৃঢ়ভাবে সংস্থাপিত হয়েছে”।

সৌভাগ্য শব্দটি সে সব শব্দের অর্ন্তভুক্ত যে সব শব্দের সঠিক অর্থের ব্যাপারে মানুষ মতানৈক্য করে থাকে। কেউ কেউ মনে করেন, আনন্দ-মজা, আরাম-আয়েশ, ধন- সম্মদ, পদমর্যাদা বা যশ-খ্যাতি ইত্যাদি অর্জন হলো সৌভাগ্য। এভাবেই অনেক মানুষ সৌভাগ্য অন্বেষণে জীবন নিঃশেষ করে দেয়। তবে হ্যাঁ, সৌভাগ্য হলো এমন এক অনুভূতি যা মানুষের অন্তরের গহীন থেকে উৎসারিত হয়, যখন সে সন্তুষ্টি, ঈর্ষা, প্রশান্তি, মহত্ব ও আনন্দ অনুভব করে। কিন্তু মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি, গুরুত্ব, দৃষ্টি-ভঙ্গি এমনকি সমাজ ভেদে সৌভাগ্যের ধরণও নানারূপ হয়ে থাকে। কেউ সৌভাগ্য খুঁজে পায় সম্পদের মাঝে, কেউ পায় ঘর-বাড়ি, যশ-খ্যাতি বা সুস্বাস্থের মাঝে, আবার অন্য কেউ তা খুঁজে পায় স্ত্রী, সন্তান, সম্পদ বা লেখাপড়ার মাঝে। আবার কেউ বা খুঁজে পায় প্রিয় ব্যক্তির নৈকট্য লাভে, বা বিরক্তকর জিনিস থেকে মুক্তি পেলে, অথবা আধ্যাত্বিক সাধনা করতে অবিবাহিত থাকা, বা গরিব মিসকিনকে সাহায্য করার মাঝে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কি আসলেই সুখী? তখন তাদের উত্তর না বোধক হয়!!!

বিশ্বের অন্যান্য জাতির চেয়ে বেশী সৌভাগ্যশীল

তাহলে আপনি দেখতে পেলেন যে, সুখী হওয়ার সংজ্ঞা মানুষ, সমাজ ইত্যাদি ভেদে নানারূপ হয়ে থাকে। এমনকি কোন কোন দেশের কিছু সংস্থা “নানা জাতির মাঝে সুখের সিড়ি” নামে ধারাবাহিক ধাপ তৈরী করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো কোন জাতি সবচেয়ে সুখী তা নির্ণয় করা। তারা নানা বিশ্লেষনের মাধ্যমে প্রত্যেক ধাপের মান নির্ধারণ করেন । কিন্তু ফলাফল ছিল সকলের জন্য এক আশ্চর্য ও অবাকজনক ব্যাপার। দেখা যায় আমেরিকানরা সবচেয়ে অসুখী জাতি, তাদের কোন সুখ শান্তি নেই, সুখ নামের চিহ্নটিই মাত্র তাদের অর্জিত হয়। অথচ আমরা জানি আমেরিকানদের উচ্চ বিলাসী জীবন যাপনের জন্য কত ধরণের চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। আরো আশ্চর্য জনক ব্যাপার হলো, নাইজেরিয়ানরা সবচেয়ে বেশী পয়েন্ট লাভ করে সুখী জাতি নির্বাচিত হয়েছে, অথচ দরিদ্রতার নির্মম কষাঘাত সে জাতিকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়!!!!

$Naseem_Sousa.jpg*

নাসিম সোসাহ

ইরাকি ইহুদি অধ্যাপক
মানবজাতির সুখ শান্তি
“এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা মানুষের আত্মতুষ্টিতে ব্যর্থ ও মানুষের শান্তির উপায় আবিষ্কারে বিফল হয়েছে, ফলে মানুষকে দুঃখ দুর্দশা এবং বিভ্রান্তির নরকে ফেলে দিয়েছে। কেননা আধুনিক বিজ্ঞানের প্রচেষ্টা ধ্বংস এবং বিনাশমুখী। এমতাবস্থায় উহা ইসলামী যুগের মত পূর্নাঙ্গতা ও মানব সেবার মাধ্যম হতে অক্ষম। ।

আমেরিকার “নিউজ উইক” সাময়িকী বিশ্বের সবচেয়ে সুখী জাতি নির্বাচনে এ পরিসংখ্যানের ফলাফল প্রকাশ করেছে। এতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নাইজেরিয়ান জাতি দারিদ্রতা সত্বেও ৬৫টি দেশের মধ্যে শীর্ষ স্থান লাভ করেছে। এর পরে আছেঃ মেক্সিকো, ভেন্যুজুয়েলা ও সালভাডর। অন্যদিকে উন্নত দেশসমূহ – এ আশ্চর্যজনকভাবে রিপোর্ট মোতাবেক- সুখের তালিকায় নিচের দিকে আছে। আমরা অধিকাংশ আমেরিকানদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা অকপটে স্বীকার করে যে, সুখ শান্তি ধন সম্পদের সাথে সম্পৃক্ত নয়[1]। আর ইহা পুঁজিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত দরকারবাদ সমাজে বিস্ময়কর মনে ব্যাপার মনে হয়। সাময়িকীটি যেদিকে ইঙ্গিত করে তা হলো সুখ শান্তির অন্বেষণে শ্বাসরূদ্ধ হয়ে আমেরিকানরা ধর্মের দিকে ছুটে চলছে[2] । যা তাদেরকে বিভিন্ন মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়।

[1] নিউইয়ার্ক সাময়িকী, আরবী সংস্করণ, ৩/৮/২০০৪, পৃষ্ঠাঃ ৫৮। [2] নিউইয়ার্ক সাময়িকী, আরবী সংস্করণ, ৬/৯/২০০৫।

সৌভাগ্যের সংজ্ঞা, ইহা অর্জনের উপায় নিয়ে বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন ধরণ দেখা যায়। যেমন মানুষের কতিপয় মানবিক গুনের সমষ্টিকে প্লেটো সুখ বলেছেন, সেগুলো হলোঃ (প্রজ্ঞা, বীরত্ব, সতীত্ব ও ন্যায়পরায়ণতা)। তিনি বলেছেন, মানুষ পরকালে তার রূহের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত চুড়ান্ত সুখী হবেনা। আর অ্যারিস্টট্ল সুখকে মহান আল্লাহ তায়া’লার দান বলে আখ্যা করেছেন, তিনি বলেছেন, ইহা পাঁচটি জিনিসের সমন্বয়ে গঠিত। সেগুলো হলোঃ সুস্থ শরীর, সুস্থ অনুভুতি, সম্পদ অর্জন ও তা সঠিকভাবে ব্যবহার, কর্মস্থলে সফলতা ও আশা পূরণ, সুস্থ বিবেক ও সঠিক বিশ্বাস, সুখ্যাতি ও মানুষের কাছে প্রিয়তা। মনোবিজ্ঞানে জীবনে সন্তুষ্টির প্রতিফলনকে সৌভাগ্য বলে। অথবা বারবার আনন্দ অনুভূতির প্রতিফলনলে সৌভাগ্য বলে[3] । কিন্তু সুখ ও সৌভাগ্যের অর্থ যাই হোক প্রকৃত সুখ কি? কিভাবে সুখী হওয়া যায়, শুধু আনন্দ ও মজা উপভোগ করাই কি সুখ?

[3] সুখ-সৌভাগ্যের সাইকোলজি, লেখকঃ মাইকেল আরজাইয়েল। অনুবাদঃ ফয়সাল আব্দুল কাদের।

সুখের ভুল অর্থ

ডালিডা

বিশ্ব বিখ্যাত গায়িকা
জীবন অসহনীয়
তিনি আত্মহত্যার আগে শেষ চিঠিতে লিখেছেন জীবন অসহনীয়!! আমাকে ক্ষমা করো।

মানুষ অনেক সময়ই বিভিন্ন আনন্দদায়ক জিনিসের পিছনে চলতে থাকে। সে সব ধরণের আনন্দ আস্বাদ করে থাকে। সে ভাবে যদি পৃথিবীর সব আনন্দ ভোগ করা যেত তবে সে সুখী হত। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো সে সবচেয়ে বেশি অসুখী। পার্থিব ভোগ বিলাস নানা প্রকার, নানা ধরণের ও গুনের, কিন্তু সব ভোগ বিলাসেই সুখ নেই। এখানেই সুখ ও ভোগ বিলাসের অর্থের মাঝে বিভ্রান্তি ঘটে। এ কথা সত্য যে, এ দুটো এক অর্থে মিল আছে, অন্য অর্থে আবার রয়েছে বিশাল পার্থক্য। দুটো থেকেই অন্তরে আনন্দ আসে, এ অর্থে মিল রয়েছে। কিন্তু পার্থক্য হলো, ভোগ বিলাস বা মজা ক্ষণিকের স্বাদ, ইহার উপকরণ বা কারণ চলে গেলে এ মজাও দ্রুত চলে যায়। কখনও কখনও এ মজার পরে অনুতাপ ও কষ্ট পেতে হয়। অন্যদিকে সুখ শান্তি স্থায়ীভাবে ব্যক্তির সাথে থাকে।

সুখ ও মজার অর্থগত মিশ্রন অনেক সময়ে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। সে মনে করে সব আনন্দ মজাই সুখ। যেমনঃ মানুষের মাঝে বিখ্যাত ও পরিচিত হওয়া অনেক বড় মজা ও আনন্দদায়ক। মানুষ তাকে বিভিন্ন সভা সেমিনারে সামনে এগিয়ে দেয়, তার কাজের প্রশংসা করে... এ সব কিছুই আনন্দদায়ক ও মজার অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু কত বিখ্যাতজন, সম্পদশালী, উচ্চ পদমর্যাদাবান বা সৌন্দর্যের অধিকারী বিষণ্ণ ও অসুখী । সর্বদা মনরোগ বিশেষজ্ঞের নিকট চিকিৎসা নেয়। বা তার এ সব বিষণ্ণতা, মর্মপীড়া ও কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করে জীবনকে শেষ করে দেয়!! কত বিখ্যাতজনের কথা শুনেছি তারা তাদের কষ্ট ও বিষণ্ণ দিনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে আত্মহত্যা করেছে!!! আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনকে নিঃশেষ করে দিয়েছে!!! অনেককে দেখতে পাবে তারা যৌন ভোগের মাঝে ডুবে থাকে, একটার পর একটা নারী পরিবর্তন করে। কিন্তু অবশেষে যখন তাকে জিজ্ঞেস করবে দেখবে সে মরণ ব্যাধি এইডস এ আক্রান্ত হয়েছে। হারাম সম্পর্ক মজার, কিন্তু এতে ঘর ও পরিবার ধ্বংস হয়, সমাজ ভেঙ্গে পড়ে ও বংশের মধ্যে অবৈধ মিশ্রণ হয়। সেক্সুয়াল সিনেমা কিছুটা মজাদায়ক, কিন্তু এতে ব্যক্তির মানসিকতা ভেঙ্গে পড়ে, পবিত্র সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় ও সতী স্বাধ্বী সমাজের সীমালঙ্ঘন করা হয়। ভোগ বিলাসের ও মজার আরেকটি উপকরণ হলো খাদ্য। কেউ কেউ ইবাদতের মতই বা তারও বেশি খাদ্যের প্রতি আগ্রহী। পরবর্তীতে সে মেদ ও ডায়বেটিকসে ভোগে। পরে দেখা যায় সে সব সময় ডাক্তার ও হাসপাতালে আসা যাওয়া করে।

সুখ ও আনন্দের মাঝে এ মিশ্রণের ফলে কোন কোন সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ দুটো দ্বারা একই জিনিস বুঝান। অনেক সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ আনন্দ ও মজার জিনিস সরবরাহ করে তাকেই সুখ বলে চালিয়ে দেন। তাদের উদ্দেশ্য হলো মানুষের বিবেকের উপর আধিপত্য বিস্তার ও নানাভাবে বিবেককে আন্দোলিত করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করা। যে যুবক প্রথম প্রথম মাদক সেবন করে শুরুতে সে মজা অনুভব করে। আস্তে আস্তে সে মাদক ব্যাবসায়ীদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়।

বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের মাল বাজারজাত করতে মানুষকে যাদুর মত আকর্ষণ করে। কিন্তু বাজারে মানুষকে দেখবে নতুন নতুন পণ্য তালাশ করছে।

তাহলে বুঝা গেল, মানুষ যা কিছু চায় তার সব কিছুতে সুখ নেই। তাহলে ধনী ও রাজা বাদশাহরা সবচেয়ে বেশি সুখী মানুষ হতেন। কিন্তু বাস্তব পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এর উল্টোটা। হয়ত ইহাই আল্লাহ তায়া’লার পূর্ণ ইনসাফের বহিঃপ্রকাশ। অনেক গরিব ও অসহায় মানুষের মাঝে সুখ পাওয়া যায়, বরং অন্তর্নিহিত অর্থে গরীবেরা ধনীদের চেয়ে অনেক সুখী! তাহলে সম্ভবত সুখ আরাম-আয়েশের মাঝে!!

অনেক মানুষ মনে করেন, আরাম-আয়েশ মানেই সুখ-সৌভাগ্য, তাই আরাম- আয়েশের দিকে ছুটতে থাকে, কিন্তু ইহা অনেক সময় তার জন্য চিন্তা, বিষণ্ণতা, একাকীত্ব ও দূর্ভাগ্য বয়ে আনে। সে ভুলে যায় যে, অনেকেই শারীরিক কষ্ট ও পরিশ্রমের মাঝে সুখ অনুভব করে। বরং কখনও কখনও কষ্ট ও পরিশ্রমই হলো সুখ। কেউ যদি একটি বাচ্চা কুয়ায় পড়েছে দেখে এবং তাকে উদ্ধারে শারীরিক কষ্ট, ব্যথা সত্বেও সে কুয়ায় নেমে তাকে উদ্ধার করে তখন সে নিজেকে অনেক সুখী মনে করবে। আপনি কি দেখেন না যে, বিজ্ঞানী, আলেম উলামা ও ছাত্ররা জ্ঞান অর্জনে কত কষ্ট সহ্য করেন, কিন্তু ইহা তাদেরকে সুখ দান করে, অনেক দুঃখ কষ্টের পরে তাদেরকে সুউচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দেয়। এমনিভাবে একজন খেলোয়াড় শরীরের অনেক ঘাম ঝড়িয়ে খেলায় সুখ অনুভব করে। ঠিক এভাবে দুঃখী, দরিদ্র ও অভাবী মানুষের সেবা করে, তাদের জন্য ব্যয় করে অনেকে সুখ অনুভব করে। কেউ আবার নিজের ধন সম্পদ গরিব মিসকিনের মাঝে ব্যয় করে সুখী হয়। তাই দেখা যায় মানুষ নিজের আরাম আয়েশ ও ভালবাসা ত্যাগ করে নিজে সুখী হতে চায়।




Tags: