প্রকৃত সৌভাগ্যের পথ চিনতে, যে পথ আল্লাহর প্রতি ঈমানের পথ, আমাদেরকে কতিপয় নিদর্শন ও চিহ্ন বর্ণনা করা দরকার, যাতে চলার পথে আমরা প্রশান্তি ও উঁচু সাহসিকতা পাইঃ
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও। (সূরা আন’আমঃ ১৫৩(
অতএব, সুখ ও সৌভাগ্যের পথ হলো বান্দাহর জন্য আল্লাহ তায়া’লার বর্ণনাকৃত পথ। -তিনিই অধিক জ্ঞাত কিসে তাদের কল্যাণ রয়েছে-। নির্বিঘ্নে বলা যায় যে, হতভাগা ও দুঃখী সেই যে আল্লাহর পথ ছেড়ে দেয়, মানব রচিত বিভিন্ন পথে সুখ অন্বেষণ করে। আল্লাহর রাস্তা ছাড়া অন্য কোন পথে কখনও সুখ আসতে পারেনা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এরপর যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে হেদায়েত আসে, তখন যে আমার বর্ণিত পথ অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ঠ হবে না এবং কষ্টে পতিত হবে না। এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। (সূরা তোয়াহাঃ ১২৩-১২৪)
সৌভাগ্য তাদের জন্য যারা আল্লাহর পথে চলে, হিদায়েত অনুসরণ করে, আর তারই জীবিকা সংকীর্ণ হবে যে আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যদিও ব্যহ্যিকভাবে সে অনেক বিখ্যাতজন ও তারকা। ‘দনকা’ হলো দুনিয়া ও আখেরাতে জীবিকা সংকীর্ণ হওয়া ও দুঃখ কষ্টে পতিত হওয়া।
একথা সবাই জানে যে, মানুষ আত্মা ও শরীর নিয়ে গঠিত। প্রত্যেকটির রয়েছে আলাদা আলাদা খাদ্য। কিছু কিছু মতবাদ ও দর্শন শুধু আত্মিক বিষয়কে খুব গুরুত্ব দেয়, আর শারীরিক চাহিদাকে উপেক্ষা করে। ফলে বিপর্যয় ঘটে। আবার এর বিপরীতে আধুনিক বস্তুবাদ দৈহিক ও পার্থিব চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় আর আত্মিক চাহিদাকে তারা উপেক্ষা করে। তারা শারীরিক চাহিদার যা ইচ্ছা তাই পূরণ করে। ফলে তা মানবিকতা থেকে চতুষ্পদ জন্তু জানোয়ারে পরিণত করে দেয় বা বন্ধ্যা যন্ত্রে পরিণত করে দেয়। অপরদিকে ইসলামের ধ্যান ধারণায় রূহকে আসমানী আলো দিয়ে ভরপূর রাখে অন্যদিকে শরীরের চাহিদাকেও সংরক্ষণ করে, পবিত্র হালাল জিনিস দিয়ে তার প্রবৃত্তি ও ক্ষুধাকে নিবারণ করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভূলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন । (সূরা কাসাসঃ ৭৭)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম হযরত সালমান ফারেসী (রাঃ) কে বলেছেনঃ “নিশ্চয় তোমার রবের প্রতি রয়েছে তোমার হক বা কর্তব্য, তোমার নিজের প্রতি রয়েছে তোমার দায়িত্ব, তোমার পরিবার পরিজনের প্রতি রয়েছে তোমার দায়িত্ব। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য অধিকার আদায় করে দাও”। (বুখারী শরীফ)
যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে তাকে কোন কিছুই এ পথ থেকে আলাদা করতে পারেনা, এমনকি তার ঘাড়ে তলোয়ার ধরেও। লক্ষ্য করুন ফেরাউনের যাদুকরদের দিকে যারা ঈমান আনলে, সৌভাগ্যের পথে চলা শুরু করলে ফেরাউন তাদেরকে শাস্তির ধমক দিল, তাদেরকে যা বলল তা কোরআনের ভাষায় এভাবে এসেছেঃ অতএব আমি অবশ্যই তোমাদের হস্তপদ বিপরীত দিক থেকে কর্তন করব এবং আমি তোমাদেরকে খর্জুর বৃক্ষের কান্ডে শূলে চড়াব এবং তোমরা নিশ্চিত রূপেই জানতে পারবে আমাদের মধ্যে কার আযাব কঠোরতর এবং অধিক্ষণ স্থায়ী। (সূরা তোয়াহাঃ ৭১)
কিন্তু তাদের জবাব ছিল সত্য ধর্মে অটল ও স্থীর থাকা। আল কোরআনে তাদের জবাব এভাবে এসেছেঃ যাদুকররা বললঃ আমাদের কাছে যে, সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছে তার উপর এবং যিনি আমাদের কে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর উপর আমরা কিছুতেই তোমাকে প্রাধান্য দেব না। অতএব, তুমি যা ইচ্ছা করতে পার। তুমি তো শুধু এই পার্থিব জীবনেই যা করার করবে। (সূরা তোয়াহাঃ ৭২)
শুধুমাত্র ঈমান আনার কিছুক্ষন পরেই তারা অটল ও স্থর রইল, কেননা তারা ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছিল, যে ঈমান তাদের রায় ও সিদ্ধান্তকে পূর্ণ প্রশান্তিময় ও স্থীর করে দিল। এমনকি হত্যার হুমকি সত্বেও।
প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা ছাড়া সুখ হয়না। আবার প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা ঈমান আনা ছাড়া আসেনা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন, যাতে তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বেড়ে যায়। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা ফাতহঃ ৪)
অতএব আল্লাহর উপর ঈমান মানুষকে দুদিক থেকে সুখ শান্তি এনে দেয়ঃ প্রথমতঃ ব্যভিচার ও অপরাধের জলাভূমিতে পিছলে যাওয়া থেকে তাকে রক্ষা করে। আর এগুলো হলো দুঃখ, দুর্দশার সবচেয়ে বড় কারণ। আল্লাহর প্রতি ঈমান ব্যক্তির ইচ্ছা ও কামনা শক্তিকে ধ্বংসাত্মক পথ থেকে রক্ষা করে। দ্বিতীয়তঃ ইহা ব্যক্তিকে সুখ-শান্তির সবচেয়ে বড় শর্ত পূরণ করে, তা হলো প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা। সীমাহীন বিপদাপদ ও সমস্যায় জর্জরিত হলে ঈমান ছাড়া উত্তরণের কোন পথ নেই। ঈমান ছাড়া ভয়ভীতি ও উদ্বেগের কারণসমূহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর ঈমানদার হলে একমাত্র মহান আল্লাহ তায়া’লার সামনে দাঁড়ানোর ভয় ছাড়া কোন ভয় ভীতি থাকে না।
মু’মিনের অন্তর সব সমস্যা ও বিপদকে তুচ্ছ মনে করে। কেননা সে মহান আল্লাহ তায়া’লার উপর ভরসা করে। আর ঈমানহীন অন্তর ডাল থেকে ঝড়ে পড়া পাতার ন্যায়, বেপরোয়া বাতাস যাকে নিয়ে যা খুশী খেলা করে। মানুষ মৃত্যু ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতার চেয়ে আর কোন জিনিসকে বেশি ভয় করে?! মু’মিনের নিকট তা ভয়ের কোন কারণ নয়, বরং তা প্রশান্তির কারণ, কেননা যার অন্তর ঈমান ও তাকওয়ায় ভরপুর তার মৃত্যু কতইনা লাভজনক!!
ঈমান মানুষের সত্তার মাঝে নিরাপত্তা ও প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়। মু’মিন ব্যক্তি নিরাপদ ও নিশ্চিন্তে আল্লাহর পথে চলতে থাকে। কেননা তার সঠিক ঈমান সর্বদা তার মাঝে মহান আল্লাহর সাহায্য, হেফাযত ও সংরক্ষণের আশা বৃদ্ধি করে। সে সর্বদা অনুধাবন করে যে, মহান আল্লাহ তায়া’লা সর্বক্ষণ তার সাথেই আছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ জেনে রেখ আল্লাহ রয়েছেন ঈমানদারদের সাথে। (সূরা আনফালঃ ১৯)
সুতরাং মুমিন ব্যক্তি যতই সমস্যায় পড়ুক, যতই পরীক্ষার সম্মুখীন হোক, মনের সব ওয়াছওয়াছা ও দৈহিক দুঃখ কষ্ট থেকে পরিত্রান পেতে হেদায়েতের আলোর দিশায় আলোকিত আল্লাহর কিতাব তার জন্য যথেষ্ট। তখন ভয়-ভীতি নিরাপত্তা ও শান্তিতে পরিণত হয়ে যায়। দুঃখ-কষ্ট সুখ ও খুশীতে ভরে যায়। এভাবেই মানসিক নিরাপত্তা ও আত্মিক শান্তি প্রাপ্তির পথ দেখায়, যা অন্য যে কোন সুখের সমান হয়না। যদিও সে দুনিয়ার অঢেল ধন সম্পত্তির মালিক হয়।
প্রকাশ থাকে যে, মানুষের জীবন তিনটি স্তরে বিভক্তঃ প্রথমতঃ দুনিয়ার জীবন, দ্বিতীয়তঃ মৃত্যুর পরে কবরের জীবন, আর তৃতীয়তঃ কিয়ামতের দিবস। সুখ শান্তি ও সৌভাগ্যের পথ এ তিনটি ধাপ পার হয়। দুনিয়া সম্পর্কে আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমাণদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত। (সূরা নাহলঃ ৯৭)
অর্থাৎ অবশ্যই দুনিয়াতে সুখ শান্তিময় পবিত্র জীবন দান করি, যদিও তার সম্পদ কম থাকে। এগুলো হবে আত্মতৃপ্তি, সন্তুষ্টি, অভ্যন্তরীন মানসিক শান্তি, নিশ্চিন্ততা, প্রশান্তি, আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান, তার প্রতি আত্মসমর্পণ, ও তার প্রতি দৃঢ় ভরসা ইত্যাদির মাধ্যমে। কবরে মু’মিনের সুখ সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ “মু’মিনগণ কবরে একটি সবুজ বাগানে থাকবে, তার জন্য কবর সত্তর হাত প্রশস্ত হবে, পূর্ণিমা রাত্রির ন্যায় তার কবর অলোকিত করা হবে”। (আল্লামা আলবানী (রাহঃ) হাদিসটিকে হাসান বলেছেন)।
আখেরাতে তার সুখ শান্তি সম্পর্কে আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর যারা সৌভাগ্যবান তারা বেহেশতের মাঝে, সেখানেই চিরদিন থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রভু অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। এ দানের ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়। (সূরা হুদঃ ১০৮)
তারা দুনিয়াতে সুখ শান্তি লাভে সফল হয়েছেন, আর আখেরাতে স্থায়ী সুখ শান্তি লাভেও সফল হবেন।
অতএব, ইসলাম চিরস্থায়ী সুখ শান্তি নিয়ে এসেছে। মানুষের পার্থিব জীবনের সুখ, আর পরকালীন জীবনের চিরস্থায়ী সুখ শান্তি। আল্লাহর নিকট যা রয়েছে তা অধিক উত্তম ও স্থায়ী । বরং আল্লাহ তায়া’লা দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-শান্তিকে পরস্পর বেঁধে দিয়েছেন, দুয়ের মাঝে কোন বিতর্ক ও বিরোধ নেই। এ দুনিয়া হলো আখেরাত ও কিয়ামতের দিনের স্থায়ী সুখের পথ মাত্র। এটা একটাই রাস্তা, দুনিয়া ও আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখের পথ। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যে কেউ দুনিয়ার কল্যাণ কামনা করবে, তার জেনে রাখা প্রয়োজন যে, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ আল্লাহরই নিকট রয়েছে। আর আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও দেখেন। (সূরা নিসাঃ ১৩৪)