তাহলে দেখা গেল যে, সুখ ও সুখের অনুরূপ জিনিসের মধ্যকার সংমিশ্রণ, সুখের নানাজনের নানা দর্শন ও সংজ্ঞা মানুষকে হত বিহ্বল ও দিশেহারা করে ফেলে। প্রকৃত সুখের সন্ধান ও অর্জনে মানুষ নিরলস অনুসন্ধান ও চেষ্টা চালিয়ে যায়।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে,জ্ঞানী বা ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি মাত্রই বিশ্বাস করে যে মানুষকে শান্তির পথে পৌঁছতে হলে অবশ্যই অস্তিত্বের বড় বড় বাস্তবতা বুঝতে হবে। এজন্য তাকে অস্তিত্বের প্রধান প্রধান বিষয় তথা জীবন, জগত ও মানুষ সম্পর্কে সঠিক চিন্তাধারার মাধ্যমে শান্তির পথ খুঁজতে হবে।
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তিনি তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা, অতঃপর শুক্রবিন্দু দ্বারা, অতঃপর জমাট রক্ত দ্বারা, অতঃপর তোমাদেরকে বের করেন শিশুরূপে, অতঃপর তোমরা যৌবনে পদর্পণ কর, অতঃপর বার্ধক্যে উপনীত হও। তোমাদের কারও কারও এর পূর্বেই মৃত্যু ঘটে এবং তোমরা নির্ধারিত কালে পৌঁছ এবং তোমরা যাতে অনুধাবন কর। (সূরা আল মু’মিন, আয়াতঃ ৬৭)
হ্যাঁ.... তার মূল হলো মাটি আর তুচ্ছ পানি। আর তার পরিণতি হলো নিষ্প্রাণ লাশ। সে তার মাঝে অপবিত্রতা বহন করে বেড়ায়। তার শরীর থেকে যা বের হয় তাও নোংরা ও অপবিত্র জিনিস। এতদসত্বেও সে তার প্রতিপালকের ব্যাপারে ঝগড়াটে, কত অকৃতজ্ঞ!! আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ মানুষ ধ্বংস হোক, সে কত অকৃতজ্ঞ! তিনি তাকে কি বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন? শুক্র থেকে তাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে সুপরিমিত করেছেন। অতঃপর তার পথ সহজ করেছেন, অতঃপর তার মৃত্যু ঘটান ও কবরস্থ করেন তাকে, এরপর যখন ইচ্ছা করবেন তখন তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। (সূরা আবাসাঃ ১৭-২২)
তথাপিও সে অন্যান্য সৃষ্টিকূল থেকে সম্মানিত, আল্লাহ তায়া’লা ফেরেশতাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষ আদম (আঃ) কে সিজদা করতে বলেছেন। তার জন্য জমিন, পশু পাখি সব কিছু অধীনস্থ করে দিয়েছেন। তাকে জ্ঞান দান করে সম্মানিত করেছেন, যা তাকে এক আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও বিস্ময়কর করেছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭০)
অতএব মানুষের মূল উপাদান উক্ত দুটি জিনিসের (তুচ্ছ বস্তু হতে সৃষ্টি এবং আল্লাহ তাআলা কর্তৃক সম্মানিত করা) ভাবনা ও চিন্তা ছাড়া বুঝা যাবেনা। এ চিন্তা তার বিশ্বাসের মাঝে সমতা আনয়ন করে, সে যে ইজ্জত-সম্মান, ধন-সম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি যা কিছুই অর্জন করুক না কেন তার সব কিছুই মহান আল্লাহ তায়া’লার দয়া ও করুনা ছাড়া কিছুই না। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তোমাদের কাছে যে সমস্ত নেয়ামত আছে, তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে। অতঃপর তোমরা যখন দুঃখে-কষ্টে পতিত হও তখন তাঁরই নিকট কান্নাকাটি কর। (সূরা নাহলঃ ৫৩)
মানুষ নিজস্ব সত্তায় এক পিণ্ড মাংস ও কিছু হাড্ডি ছাড়া আর কিছু না। উপকারী ইলম ও সৎকর্ম তাকে সংস্কার ও সভ্য করে সম্মানিত করে তোলে। তার দুর্বলতা ও অক্ষমতা সত্বেও মহান আল্লাহ তায়া’লা তাকে এমন এক মহিমান্বিত আমানত বহনের জন্য উপযোগী করে তোলেন যে আমানত তার চারপাশের অন্যান্য সব সৃষ্টিকূল গ্রহণ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আকাশ পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত পেশ করেছিলাম, অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হল; কিন্তু মানুষ তা বহণ করল। নিশ্চয় সে জালেম-অজ্ঞ। (সূরা আহযাবঃ ৭২)
উক্ত দুটি হাকিকতের মাঝে সমতার ব্যাপারে মানুষ যখন তার ঈমান ভঙ্গ করে, তখন হয়ত তার মন প্রথম হাকিকতের দিকে তাকাবে, তখন সে নিজেকে নিছক একটা শরীর, নোংরা আবর্জনা ও খেল তামাশা, খামখেয়ালীপনা দেখতে পাবে যার কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই। তখন সে অন্যান্য জীব জন্তুর ন্যায় আনন্দ উল্লাস ও মজা করবে। এভাবে সে নিজেকে হীন ও অপমানিত করবে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর যারা কাফের,তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে এবং চতুস্পদ জন্তুর মত আহার করে। তাদের বাসস্থান জাহান্নাম। (সূরা মুহাম্মদঃ ১২)
অথবা সে যদি শুধু তার দ্বিতীয় হাকিকতের দিকে তাকায় তখন তা তার আকল বা বিবেকের সীমালঙ্ঘন করে। তখন সে মহান আল্লাহ তায়া’লার দিকেপ্রত্যাবর্তনকে ভুলে অহংকার ও সীমালঙ্ঘনের পথে পা বাড়ায়। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ সত্যি সত্যি মানুষ সীমালংঘন করে, এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার দিকেই প্রত্যাবর্তন হবে। (সূরা আলাকঃ ৬-৮)
অতএব মানুষ নিজের সম্পর্কে জানা উচিত, সে নিজে নিজের সাথে চিন্তা ভাবনা করা উচিত। মানুষের দুর্দশা ও কষ্টের অন্যতম কারণ হলো সে নিজেকে জানেনা এবং সমাজে তার অবস্থান কোথায় সে তা জানেনা। সে কে? তার প্রকৃত মর্যাদা কি? তার কি করা উচিত? ইত্যাদি জানেনা।
আল্লাহ তায়া’লা সমস্ত অস্তিত্বশীল জিনিস সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টি অনর্থক ও বিফল নয়। তিনি অনর্থক কাজ করা থেকে মহাপবিত্র। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না? অতএব শীর্ষ মহিমায় আল্লাহ, তিনি সত্যিকার মালিক, তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি সম্মানিত আরশের মালিক। (সূরা মু’মিনুনঃ ১১৫-১১৬)
তিনি সৃষ্টিকূলকে তাঁর পূর্নাংগ ইবাদত করতে সৃষ্টি করেছেন। তাদের সমস্ত কাজ কর্ম, খেলাধুলা, আনন্দ বিনোদন ইত্যাদিসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইবাদত শামিল। ইবাদত শুধু নিদর্শন ও চিহ্নগত অর্থে নয়, বরং সামগ্রীক অর্থে জীবনের সবক্ষেত্রেই তাঁর ইবাদত করা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এ বাস্তবতা জানেনা, সে অজ্ঞতার মাঝে দুর্বিপাক খায়, সন্দেহ, হয়রানিতে ভোগে, ফলে জীবনে দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হয়। তখন তার কাছে সুখ ও ইবাদত ভিন্ন হয়ে যায়, তার পার্থিব জীবন থেকে ইবাদত ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে আখেরাত থেকে দুনিয়া আলাদা হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ তায়া’লা আসমান ও জমিনেরর সব সৃষ্টিকূল তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এবং আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন তোমাদের, যা আছে নভোমন্ডলে ও যা আছে ভূমন্ডলে; তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা জাসিয়াঃ ১৩)
মানুষের বুঝা উচিত যে, সে তার প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য এ পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে প্রেরিত। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন এবং একে অন্যের উপর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন, যাতে তোমাদের কে এ বিষয়ে পরীক্ষা করেন, যা তোমাদেরকে দিয়েছেন। আপনার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তি দাতা এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সূরা আন’আমঃ ১৬৫)
মানুষ তার অস্তিত্বের প্রকৃত স্বরূপ জানলে সে নিজেই জীবনের প্রকৃত অবস্থা জানতে চিন্তা গবেষণা করবে, কেননা তাকে এ স্বভাব প্রকৃতি দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। জীবনই মানুষের মৌলিক জিনিস, দুনিয়ার সমস্ত মজা, আনন্দ আয়েশ এর দ্বারাই হয়। জীবনের উপর নির্ভর করেই মানুষের অন্তর যা করতে আগ্রহী ও যেসব জিনিসের দিকে ঝোঁকে সে সব কাজ করার আকাংখা হয়। তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য কি?! জীবন মরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো মানুষকে পরীক্ষা করা, কে তাদের মাঝে কর্মে শ্রেষ্ঠ তা জানা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়। (সূরা মুলকঃ ২)
ইহাই হলো মানুষের প্রকৃত অবস্থা। কিন্তু অধিকাংশ লোকই ইহা জানেনা। হ্যাঁ.. ইহাই দুনিয়ার জীবনের হিকমত। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ পার্থিব জীবনের উদাহরণ তেমনি, যেমনি আমি আসমান থেকে পানি বর্ষন করলাম, পরে তা মিলিত সংমিশ্রিত হয়ে তা থেকে যমীনের শ্যামল উদ্ভিদ বেরিয়ে এল যা মানুষ ও জীব-জন্তুরা খেয়ে থাকে। এমনকি যমীন যখন সৌন্দর্য সুষমায় ভরে উঠলো আর যমীনের অধিকর্তারা ভাবতে লাগল, এগুলো আমাদের হাতে আসবে, হঠাৎ করে তার উপর আমার নির্দেশ এল রাত্রে কিংবা দিনে, তখন সেগুলোকে কেটে স্তুপাকার করে দিল যেন কাল ও এখানে কোন আবাদ ছিল না। এমনিভাবে আমি খোলাখুলি বর্ণনা করে থাকি নিদর্শণসমূহ সে সমস্ত লোকদের জন্য যারা লক্ষ্য করে। (সূরা ইউনুসঃ ২৪)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা নির্গত হয়; অতঃপর তা এমন শুস্ক চুর্ণ-বিচুর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এ সবকিছুর উপর শক্তিমান। (সূরা কাহফঃ ৪৫)
আমরা যে জীবনে জীবিত আছি তা অতিক্রম করার পথ, স্থায়ী সময় নয়। ইহা আখেরাতের জীবনের সাঁকো। পার্থিব জীবনেই মানুষের জীবন শেষ হবেনা। পরকালে আসল জীবন রয়েছে। পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা ও পারস্পরিক অহমিকা ব্যতীত আর কিছু নয়। যেমন আল্লাহ তায়া’লা বলেছেনঃ তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়। (সূরা হাদীদঃ ২০)
উপরোক্ত আয়াতে কারীমা দুনিয়ার যাবতীয় জীবনকে দুর্বল, তুচ্ছ ও মূল্যহীন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মানবাত্মাকে এর অনেক উর্ধ্বে তুলে ধরেছে। দুনিয়াকে আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত করেছে। দুনিয়াকে যদি আলাদাভাবে তার বৈশিষ্ট্যাবলী ও নিজস্ব পরিমাপে পরিমাপ করা হয় তবে একে অনেক বড় ব্যাপার মনে হবে। আর একে যদি আখেরাতের পরিমাপে মাপা হয় তবে একে খুবই সামান্য, নগণ্য, ক্রীড়া-কৌতুক,সাজ-সজ্জা,পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছুই মনে হবেনা। ইহাই সমস্ত বাহ্যিক বড় বড় জিনিসের অন্তর্নিহীত বাস্তবতা। হ্যাঁ... ইহাই দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতা.....। ইহাই প্রকৃত অবস্থা যখন মানুষের অন্তর গভীরভাবে বাস্তবতা জানতে চিন্তাভাবনা করবে। তবে দুনিয়ার জীবনের এ বাস্তবতাকে পবিত্র কোরআন আলাদা বা ছিন্ন করতে বলেনি, পৃথিবী আবাদ ও দুনিয়ার পরিচালনাকে গুরুত্বহীন বা অবমূল্যায়ন করতে বলেনি। কোরআন শুধু মানুষের অনুভুতি, মানসিক মূল্যায়নকে সঠিক করার উদ্দেশ্য নিয়েছে, দুনিয়ার ক্ষনস্থায়ী ভোগলিবাস ও আকর্ষণের চাকচক্যের উপরে উঠতে বলেছে। কেননা দুনিয়া শুধুমাত্র একটি সেতু যার উপর দিয়ে সমস্ত সৃষ্টিকূল আখেরাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ দুনিয়া খুবই ক্ষুদ্র ও ক্ষণস্থায়ী যা চিরস্থায়ী আখেরাতের তুলনায় কিছুই না। যেখানে মানুষ তার প্রতিদান পাবে। এছাড়া চিরস্থায়ী আখেরাতের ফলাফল মানুষের দুনিয়ার জীবনের উপরই নির্ভর করে। অতএব দুনিয়া সর্বদাই পরীক্ষার জায়গা। এখানে ভোগ বিলাস, আনন্দ-মজা বা দুঃখ কষ্ট, ব্যথা বেদনা ও দুর্দশা সব কিছুই সামান্য কয়েক দিনের জন্য, যা অতি দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। তার চিরস্থায়ী ঠিকানা নির্ধারনে সমস্ত আমলনামাই কিয়ামতের দিনে দাড়িপাল্লায় ওজন করা হবে। তাহলে তুমি কবরে কি নিয়ে যাচ্ছ? আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছ,আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম,তা পশ্চাতেই রেখে এসেছ। আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদের কে দেখছি না। যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল যে,তারা তোমাদের ব্যাপারে অংশীদার। বাস্তুবিকই তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবী উধাও হয়ে গেছে। (সূরা আন’আমঃ ৯৪)
অধিকাংশ মানুষের কি হলো তারা এ প্রকৃত অবস্থা থেকে গাফিল! ইহাই আল্লাহ তায়া’লা বলেছেনঃ তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক জানে এবং তারা পরকালের খবর রাখে না। (সূরা রূমঃ ৭)
এটা কিভাবে সম্ভব! যারা পার্থিব জীবনেই সন্তুষ্ট থাকে আর তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করেনা?! আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ অবশ্যই যেসব লোক আমার সাক্ষাৎ লাভের আশা রাখে না এবং পার্থিব জীবন নিয়েই উৎফুল্ল রয়েছে, তাতেই প্রশান্তি অনুভব করেছে এবং যারা আমার নির্দশনসমূহ সম্পর্কে বেখবর। এমন লোকদের ঠিকানা হল আগুন সেসবের বদলা হিসাবে যা তারা অর্জন করছিল। (সূরা ইউনুসঃ ৭-৮)
কি অবস্থা হবে তাদের যারা পরকালের উপর দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়?!! আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তখন যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে, এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেছে এবং খেয়াল-খুশী থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত। (সূরা নাজিয়াতঃ ৩৭-৪১)
হ্যাঁ, কেননা তারা স্বীয় ধর্মকে তামাশা ও খেলা বানিয়ে নিয়েছে এবং পার্থিব জীবন তাদের কে ধোকায় ফেলে রেখেছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তারা স্বীয় ধর্মকে তামাশা ও খেলা বানিয়ে নিয়েছিল এবং পার্থিব জীবন তাদের কে ধোকায় ফেলে রেখেছিল। অতএব, আমি আজকে তাদেরকে ভুলে যাব; যেমন তারা এ দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল এবং যেমন তারা আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করত। (সূরা আ’রাফঃ ৫১)
হ্যাঁ, যেহেতু তারা এর বিনিময়ে বক্রতা অন্বেষণ করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যারা পরকালের চাইতে পার্থিব জীবনকে পছন্দ করে; আল্লাহর পথে বাধা দান করে এবং তাতে বক্রতা অন্বেষণ করে, তারা পথ ভুলে দূরে পড়ে আছে। (সূরা ইবরাহীমঃ ৩)
এর অর্থ এটা নয় যে, দুনিয়ার জীবনকে অবজ্ঞা করে জ্ঞান বিজ্ঞান ও কাজ কর্মের দ্বারা পৃথিবীর পরিচালনা ও আবাদ ছেড়ে দিয়ে বৈরাগ্য ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করবে আর মউতের অপেক্ষা করবে। এটা কখনও নয়... বরং উত্তম পথ হলো দুনিয়াকে সাথে নিয়েই চলা ও কাজ কর্ম করা যেভাবে আল্লাহ তায়া’লা বলেছেনঃ আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভূলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা কাসাসঃ ৭৭)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, তা পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা বৈ নয়। আর আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উত্তম ও স্থায়ী। তোমরা কি বোঝ না? (সূরা কাসাসঃ ৬০)
এসব পরিপূরক চিন্তাভাবনা মানুষের কাছে জীবনকে অনেক মূল্যবান জিনিস করে তুলে যা তাকে বিনিয়োগ করা ও কাজে লাগানো অত্যাবশ্যকীয় করে। মৌলিকভাবে ইহা পরকালের স্থায়ী সুখ শান্তির জীবনের সেতু হওয়ার বেশি গুরুত্ব রাখেনা। আর দুনিয়ার সৌন্দর্য, চাকচিক্য ইত্যাদি যা কিছু আছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা বৈ কিছু নয়। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী,সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব,গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মত আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়। (সূরা আলে ইমরানঃ ১৪)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য এবং স্থায়ী সৎকর্মসমূহ আপনার পালনকর্তার কাছে প্রতিদান প্রাপ্তি ও আশা লাভের জন্যে উত্তম। (সূরা কাহফঃ ৪৬)
ইহার সুন্দর ব্যবহার জানলে প্রকৃত পক্ষে কেউ একে অপছন্দ করতে পারেনা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনি বলুনঃ আল্লাহর সাজ-সজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্রবস্তুসমূহকে কে হারাম করেছে? আপনি বলুনঃ এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্যে এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে। এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্যে যারা বুঝে। (সূরা আ’রাফঃ ৩২)
এ ভাবনা ও বিশ্বাসই একজন মুসলমানকে দুনিয়ার ভোগ বিলাস ও পার্থিব অংশ ব্যবহারে পরিচালিত করে। সে সর্বদা বিশ্বাস করে যে, সে যা কিছুর মালিক তা অস্থায়ী। সে সর্বদা অপচয় ব্যতীত এগুলো ভোগ করে। তার অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস থাকে যে, দুনিয়ার যা কিছুর সে মালিক তা তার হাতের মুঠোয়, অন্তরের মাঝে তার স্থান নয়। তার থেকে যা ছুটে যায়, বা যে সব বিপদ আপদ আসে তা তার ক্ষতি করতে পারেনা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। এটা এজন্যে বলা হয়, যাতে তোমরা যা হারাও তজ্জন্যaে দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তজ্জন্যে উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা হাদীদঃ ২২-২৩)
এভাবে মুসলমান আনন্দ, ভোগ-বিলাস ও সৌন্দর্য উপভোগ করে, সাথে সাথে তার জন্য মহান আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ থেকে রয়েছে প্রতিদান। তার কাছে দুনিয়া আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত, দৈহিক ও শারীরিক আনন্দ উপভোগ অন্তরের আনন্দের সাথে যুক্ত, দুনিয়ার ভোগের মাধ্যমে অর্জিত সুখ শান্তি তার অভ্যন্তরীণ পরিতুষ্টি ও প্রশান্তির সাথে সম্পৃক্ত।
মুসলমানের অস্তিত্বের চিন্তা ভাবনা তাকে তৃতীয় কেন্দ্রে ভাবাতে নিয়ে যায়, আর সেটা হলো তার চারিদিকের মহাবিশ্ব যাতে সমস্ত অস্তিত্বের বসবাস, সে তখন ইহা নিয়ে ভাবতে থাকে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তাহলে আপনি বলে দিন, চেয়ে দেখ তো আসমানসমুহে ও যমীনে কি রয়েছে। আর কোন নিদর্শন এবং কোন ভীতিপ্রর্দশনই কোন কাজে আসে না সেসব লোকের জন্য যারা মান্য করে না। (সূরা ইউনুসঃ ১০১)
আল কোরআনের অসংখ্য আয়াতে কারীমা মানুষকে আল্লাহ তায়া’লার সৃষ্টি ও সুনিপুণ সৃজন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে আহবান করেছে। যাতে অনুরুপ ফলাফল লাভ হয় যেমন হয় অস্তিত্ব ও জীবনের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করলে। সে আবিষ্কার করবে যে, মহাবিশ্বের চিন্তা ভাবনা তাকে নিম্নোক্ত দুটি পরিপূরক বাস্তবতা বুঝতে ও তার সাথে চলতে বাধ্য করবেঃ
প্রথম বাস্তবতা হলো আল্লাহ তায়া’লা এ মহাবিশ্বের অধিকাংশ সৃষ্টিকূল তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন। যেহেতু তিনি সব সৃষ্টির উপর মানুষের শুধু মর্যাদাই দেননি বরং তাদের খেদমতে ও আনন্দ উপভোগে সব কিছু অধীনস্থ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যাকিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ন করে দিয়েছেন? এমন লোক ও আছে; যারা জ্ঞান, পথনির্দেশ ও উজ্জল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বাকবিতন্ডা করে। (সূরা লোকমানঃ ২০)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ তিনিই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করেছেন রাত্রি, দিন, সূর্য এবং চন্দ্রকে। তারকাসমূহ তাঁরই বিধানের কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। নিশ্চয়ই এতে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা নাহলঃ ১২)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব, তোমরা তার কাঁধে বিচরণ কর এবং তাঁর দেয়া রিযিক আহার কর। তাঁরই কাছে পুনরুজ্জীবন হবে। (সূরা মুলকঃ ১৫)
মহাবিশ্বকে যে মানুষের জন্য অধীনস্থ করে দিয়েছে সে ব্যাপারে মুসলমান কোরআনে অনেক আয়াতে স্পষ্ট দলিল প্রমাণ পাবে। এতে মহাবিশ্বের প্রতি নতুন করে ভাবনা চিন্তা করার সূক্ষ্ম ইশারা রয়েছে। এবং নানা বিপর্যয় ও দুর্যোগে ধৈর্যহারা হতে নিষেধ করার অন্তর্দর্শন রয়েছে। প্রকৃতি সর্বদা দুর্বল মানুষের সাথে বিরোধে লিপ্ত নয়। আবার মানুষও সর্বদা প্রকৃতির উপর জয়লাভ করতে বিরোধে লিপ্ত নয়।
আর দ্বিতীয় বাস্তবতা হলোঃ মহাবিশ্বের সব রহস্য এখনও মানুষের কাছে আবিষ্কৃত নয়। ইহাকে মানুষের অধীনস্থ করে দেয়ার পরেও এতে অনেক জীব ও প্রাণী রয়েছে যা মানুষের অনুধাবনের বাহিরে বা তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে অক্ষম। যেমনঃ মহাবিশ্বে অসংখ্য ফেরেশতা ও জ্বীন জাতির বিচরণ। এতে আরো অনেক সৃষ্টি রয়েছে যা মানুষের পক্ষে এর প্রকৃত অবস্থা অজানা অথবা সে এর অস্তিত্ব সম্পর্কেই অজ্ঞ। এ মহাবিশ্বে মানুষের অস্তিত্ব নিছক একটি ছোট পরমাণুর মতই, যা বড় বড় সৃষ্টির সামনে অনুল্লেখযোগ্য প্রায়।
উপরোক্ত দুটি বাস্তবতা মহাবিশ্ব সম্পর্কে মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিপূর্ণ করে। সে সমস্ত সৃষ্টির মাঝে তার মর্যাদা বুঝতে পারে, যেহেতু আল্লাহ তায়া’লা তাকে সৃষ্টির মূল কেন্দ্রবিন্দু করেছেন, অন্যান্য সৃষ্টিকূল তার অধীনস্থ করেছেন। একই সময় সে জানে যে আরো অনেক কিছুর প্রকৃত রহস্য তার সামনে অজ্ঞাত। তার ক্ষমতা ও সক্ষমতা যতই উচ্চে পৌঁছুক, সে কখনও সে সবের ধারে কাছেও যেতে পারবেনা।
আর মানুষের চারপাশে বিদ্যমান অন্যান্য জিনিসের সাথে তার সম্পর্ক হলো সুসংগঠিত ও গভীর শিষ্টাচারীতায় শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। অতঃএব যারা চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে বিশৃঙ্খলার জীবন যাপন করে তারা দুর্ভোগ, দুর্দশা, কষ্টে থাকে, না পারে একে ছেড়ে চলে যেতে, আর না পারে ইহার সঙ্গে মিলে চলতে। কেননা তাদের সম্পর্ক হলো অসম ও বিশৃঙ্খল। ফলে তাদের সম্পর্ক স্বার্থপরতা,খলতা, খারাপ অনুমান,ষড়যন্ত্র এবং অপরের অনিষ্টতা ইত্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ সব কিছু মানুষকে অসুখী ও অসন্তুষ্ট করে তোলে। তাকে মানসিক টেনশন, উত্তেজনা ও কঠিন কষ্টে ভোগায়। সে সর্বদা টেনশন ও উত্তেজনায় থাকে। তাহলে কোথা থেকে তার সুখ শান্তি ও আরাম আয়েশ আসবে?! আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ সমান নয় ভাল ও মন্দ। জওয়াবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সাথে যে ব্যক্তির শুত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ চরিত্র তারাই লাভ করে, যারা সবর করে এবং এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয়, যারা অত্যন্ত ভাগ্যবান। (সূরা হা-মীম সিজদা, আয়াতঃ ৩৪-৩৫)
অন্যদিকে যে সব মানুষ তার জীবনকে সুশৃঙ্খল করেছে ও অন্যান্যের সাথে তার সম্পর্ক অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্যের ভিত্তিতে গড়েছে, সে সর্বদা তার দায়িত্ব পালন করে। অধিকার আদায়ে সহজতা করে, তার প্রতিপক্ষের ভুলত্রুটি মার্জনা করে । নিঃসন্দেহে সে একজন সুখী মানুষ। মানুষের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে মায়া মমতা শ্রেষ্ঠ পন্থা। মায়া মমতা হলো ভালবাসা, অন্তরঙ্গতা এবং ব্যাকুল কামনা। এ সব কিছুই মানুষের সুস্থ স্বভাব-প্রকৃতি।
এ বিশ্বাসে মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার সাথে, নিজের ও তার চারপাশের মহাবিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যবিধান করে চলে। সে প্রথমেই আল্লাহর ইবাদতের হাকিকত জানতে পারে, তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব কর্তব্য আদায় করে। দ্বিতীয়ত সে নিজের এ মর্যাদা বুঝতে পারে যে, আল্লাহ তায়া’লা তাকে অন্যান্য সৃষ্টির সেরা করেছেন, সব সৃষ্টি তার অধীনস্থ করেছেন। তাকে যে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেখানে ফিরে যাওয়ার পূর্বে জমিনে তাকে পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। এ পৃথিবীর আবাদ কাজ তার উপর অর্পিত। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তিনিই যমীন হতে তোমাদেরকে পয়দা করেছেন, তন্মধ্যে তোমাদেরকে বসতি দান করেছেন। অতএব; তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর অতঃপর তাঁরই দিকে ফিরে চল আমার পালনকর্তা নিকটেই আছেন, কবুল করে থাকেন; সন্দেহ নেই। (সূরা হুদঃ ৬১)
সে আরো দায়িত্বপ্রাপ্ত যে, শরিয়তের সীমারেখা মেনে ও প্রয়োজন অনুসারে নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করবে। স্রষ্টা, আত্মা ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে যখন আমাদের এ ধারণা ও বিশ্বাস হবে তখন স্বভাবতই আমাদের সামনে কতিপয় ফলাফল এসে দাঁড়াবে, যা আমরা উক্ত ধারণার বাস্তবতা থেকে পেয়ে যাই। মানুষ যখন উক্ত হাকিকতগুলো জানতে পারবে, তখন সে স্বভাবতই বুঝবে যে, ইহ ও পরকালীন সুখ শান্তি আল্লাহ তায়া’লার সন্তুষ্টি, তার আদেশ মানা ও নিষেধ থেকে বিরত থাকার মধ্যেই নিহিত। এতে শারীরিক ও আত্মিক চাহিদার মাঝে সমতা বাস্তবায়িত হবে। ব্যক্তি ও সমষ্টির চাহিদা, দুনিয়া ও আখেরাতের আবাদের মাঝে সমতা আসবে। দুনিয়াতে সে সুখে শান্তিতে থাকবে – সুখ যতই কম হোক না কেন-। কেননা দুনিয়া হলো পরিশ্রম, কর্ম ও পরীক্ষার স্থান। আর আখেরাত হলো হিসেবের স্থান। যে ব্যক্তি সেখানে সফল হবে সেই চিরকাল পূর্ণ সুখ ও সৌভাগ্য লাভ করবে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তাদের সুসংবাদ দিচ্ছেন তাদের পরওয়ারদেগার স্বীয় দয়া ও সন্তোষের এবং জান্নাতের, সেখানে আছে তাদের জন্য স্থায়ী শান্তি। তথায় তারা থাকবে চিরদিন। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে আছে মহাপুরস্কার। (সূরা তাওবাঃ ২১-২২)
দুনিয়া ও আখেরাতে মানবিক শান্তি, আশ্বস্তি অনুভব ও সুন্দর পবিত্রতম জীবন লাভের জন্য অবশ্যই আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হবে ও সৎকাজ করতে হবে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমাণদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত। (সূরা নাহলঃ ৯৭)