যখনই মানুষ আসমানী হিদায়েত ও নবী রাসুলের রিসালাত থেকে দূরে সরে গেছে, তখনই মানবজাতির উপর দূর্ভাগ্য ও অন্ধকার নেমে এসেছে। তাই তাদেরকে হেদায়েতের পথে আনতে আল্লাহ তায়া’লা একের পর এক নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন। সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রসূলগণকে প্রেরণ করেছি,যাতে রসূলগণের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রাজ্ঞ। (সূরা নিসাঃ ১৬৫)
তিনি রাসুল প্রেরণ ব্যতীত কাউকে আযাব ও শাস্তি দিবেন না। কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না। (সূরা বনী ইস্রাইলঃ ১৫)
তিনি ঈসা (আঃ) কে প্রেরণ করার পরে যখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেন তখন মানবজাতি জাহেলিয়াত, ভ্রষ্টতা, অত্যাচার-অবিচার ও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তখন আসমানী ধর্মগুলো কতিপয় মিথ্যাবাদী পরিবর্তনকারীদের দ্বারা রূপান্তরিত ও পরিবর্তীত হয়ে গিয়েছিল। তারা বিশুদ্ধ তাওহীদকে পৌত্তলিকতা ও শিরকে রূপান্তরিত করেছিল। তারা আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা চালিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহর স্বত্বা নিয়ে নানারূপ মিথ্যা কথাবার্তা বানিয়ে বানিয়ে বলত। ইবাদত ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আহলে কিতাব, পৌত্তলিক ও মূর্তিপুজকদের মাঝে কোন পার্থক্য ছিলনা। শিরক ও নাস্তিকতার মহাধ্বংসস্তুপের মাঝে তাওহীদের আলো নিভে গিয়েছিল। আল্লাহর কালামকে পরিবর্তন ও রূপান্তর করেছিল। আহলে কিতাবরা যে সব ওয়াদা ও অঙ্গিকার করেছিল তা ভঙ্গ করেছিল, তারা আল্লাহর কালামকে পশ্চাতে ফেলে দিল। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তারা সত্য গোপন করেছিল, মিথ্যাকে প্রকাশ করেছিল। নিজেদের চিত্তপ্রসাদ করতে আল্লাহর হক ও বান্দার হকের ব্যাপারে আল্লাহর হারামকৃত জিনিসে দুঃসাহস দেখিয়েছিল। তারা কিছু পদমর্যাদা ও সামান্য অর্থের বিনিময়ে সত্য গোপন করেছিল। যেমন হয়েছিল তাদের কতিপয় নেতাদের সাথে যারা নিজেদের খামখেয়ালীর অনুসরণ করত, সত্যের উপরে প্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দিত। ফলে সর্বদা যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত, স্বৈরশাসন চলছিল, মানবজাতি ঘোর অন্ধকারে বসবাস করত। কুফুরী ও অজ্ঞতার অন্ধকারে মানুষের আত্মাও অন্ধকারাচ্ছন্ন ও কলুষিত হয়ে গিয়েছিল। নৈতিকতা পদদলিত হয়েছিল, মান সম্মান লুণ্ঠিত হয়েছিল, অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল। জলে স্থলে সর্বত্র ফিতনা ফাসাদ দেখা দিয়েছিল। অবস্থা এতই ভয়াবহ ছিল যে, যদি বিবেক সম্পন্ন কেউ একটু চিন্তা করে তাহলে বুঝতে পারবে সে সময় মানবতা কতটা সঙ্কটাপন্ন ও বিপন্ন ছিল। মানবতা প্রায় বিস্মৃত হতে লাগছিল, যতক্ষণ না আল্লাহ তায়া’লা মানবজাতিকে পথ দেখাতে ও সরল সঠিক পথের সন্ধান দিতে তাদের কল্যাণে নবুয়্যাতের আলো প্রজ্বলিত করলেন ও হিদায়েতের আলো জ্বালিয়ে দিলেন।
মানবজাতিকে মুক্তি দিতে সেই ঘোর অন্ধকারে আল্লাহ তায়া’লা তাঁর নবীকে পাঠালেন। তিনি হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম। তাঁকে তিনি মনোনীত করলেন, যাতে তিনিঃ তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। (সূরা আহযাবঃ ৪০)
মানবজাতিকে ভ্রষ্টতা ও দূর্দশা থেকে মুক্তি দিতে তাঁকে তিনি হেদায়েতের আলোকবর্তীকা নিয়ে প্রেরণ করলেন। ফলে আল্লাহ তায়া’লা এ দ্বীনকে মানবজাতির জন্য পূর্ণ করলেন, তিনি তার নেয়ামত পরিপূর্ণ করলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বিশ্ববাসীর নিকট এ সত্য পৌঁছে দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭)
যাতে তারা শান্তির পথের সন্ধান পায়।
তিনি (সাঃ) তার এ দাওয়াতী কাজে দুনিয়ার কোন স্বার্থ কামনা করেননি, মানুষের থেকে কোন প্রতিদানও চাননি। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলুন,আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না আর আমি লৌকিকতাকারীও নই। (সূরা ছোয়াদঃ ৮৬)
বরং আল্লাহ তায়া’লা তাঁকে দুনিয়ার সম্রাট ও রাসুল অথবা তাঁর একনিষ্ঠ বান্দা ও রাসুল হওয়ার মাঝে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল হওয়াকে বেছে নিয়েছেন। তিনি (সাঃ) মানুষ ছিলেন, অন্যান্য মানুষের মতই জীবন যাপন করেছেন, তার সাথীরা যেভাবে ক্ষুধার্ত হতেন তিনিও সেভাবে ক্ষুধার্ত হতেন, তারা যেমন ব্যথা অনুভব করত তিনিও সেভাবে ব্যথা অনুভব করতেন, তাদের সাথে কাজ করতেন, তিনি নিজে আল্লাহর বান্দা হওয়ায় গর্ববোধ করতেন। আল্লাহ তায়া’লা যখনই তাকে সম্মানিত করতে চাইতেন তখন তিনি তাকে নিজের বান্দা বলে উল্লেখ করতেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি নিজের বান্দার প্রতি এ গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তাতে কোন বক্রতা রাখেননি। (সূরা কাহফঃ ১)
বরং তিনি নিজেই মানুষদেরকে সতর্ক করতেন যারা তাঁর ব্যাপারে বেশি বাড়াবাড়ি করতেন, বা তার অধিকারের চেয়ে বেশি সম্মান দিতেন, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেনঃ “তোমরা আমার ব্যাপারে এত উচ্চপ্রশংসা করনা, যেমনিভাবে খৃস্টানরা মারইয়ামের পুত্র ঈসা (আঃ) সম্পর্কে করে থাকেন, আমি হলাম আল্লাহর বান্দাহ, তাই আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রাসুল বলো”। (বুখারী শরিফ)। যারাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে দেখেছেন ও জেনেছেন তারা তাঁর সততা দেখেছেন, তাঁর চাল চলন বা সিরাত দেখে হতভম্ব ও আশ্চর্য হয়েছেন। তাঁর সুন্দর আখলাক দেখে সবাই অভিভূত হয়েছেন। কেনইবা হবেন না, তাঁর বন্ধুদের আগে চরম শত্রুরাও এবং মুসলমানদের আগে কাফেররাও তাঁর মহান চরিত্রের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়া’লার সাক্ষ্যই তাঁর জন্য যথেষ্ট, তিনি বলেনঃ আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।(সূরা ক্বলমঃ ৪)
বরং এটাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তায়া’লা তাঁকে সর্বশেষ নবী ও রাসুল হিসেবে মনোনীত করেছেন। যখন তাঁর মিশন শেষ হয়ে গেছে তখন আল্লাহ তায়া’লা তার মৃত্যু দান করেছেন, কিন্তু তাঁর রিসালাত মানবজাতির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট রেখেছেন।