ইসলামী শরিয়ত কতিপয় অসাধারণ মূলনীতি ও ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যা সকল মানুষের জন্য সর্বযুগে ও স্থানে প্রযোজ্য। এসব মূলভিত্তির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিম্নরূপঃ
ইসলামী শরিয়াতের সব বিধি-বিধান বান্দাহর চেষ্টা ও সাধ্যের মধ্যে। সাধারণ কাজকর্মের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু করতে হয়না। কেননা দ্বীন হলো সহজ। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না। (সূরা বাকারাঃ ১৮৫)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ তোমাদের বোঝা হালকা করতে চান। মানুষ দুর্বল সৃজিত হয়েছে। (সূরা নিসাঃ ২৮)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। (সূরা বাকারাঃ ২৮৬)
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেনঃ “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ থেকে) কোন দুটো বিষয়ের ব্যাপারে পছন্দ করতে বললে তিনি সহজতর বিষয়টি পছন্দ করতেন, যতক্ষণ এতে গুনাহ না হয়। আর গুনাহের সম্ভাবনা থাকলে যেটা দ্বারা গুনাহ থেকে বেশি দূরে থাকা যায় সেটা পছন্দ করতেন। আল্লাহর কসম! তিনি কখনও তাঁর নিজের ব্যাপারে কোন কিছুর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি, যতক্ষণ না আল্লাহর হারামসমূহকে ছিন্ন করা হত। তা হয়ে থাকলে আল্লাহর জন্য প্রতিশোধ নিতেন। (বুখারী শরিফ)
ইসলামী শরিয়তে কঠোরতা ও কষ্ট পরিহারের অন্যতম দিক হলো কম আদেশ নিষেধ করা, যাতে কষ্ট ও ক্লান্তি ছাড়াই এসব বিধি-বিধান পালনে বান্দাহর জন্য সহজ হয়। কেননা ক্লান্তিতে রয়েছে জটিলতা ও সংকীর্ণতা। আর কঠোরতা ও জটিলতা ইসলামী শরিয়ত থেকে দূর করা হয়েছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এবং ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেননি। (সূরা হাজ্বঃ ৭৮)
এমনিভাবে শরিয়তের আদেশ নিষেধের উদ্দেশ্য হলো বান্দাহকে দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-শান্তিতে পৌঁছানো। তাই সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাহিরে ইসলামী শরিয়ত কিছুই আবশ্যক করে দেয়নি। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ হে মুমিণগন, এমন কথাবার্তা জিজ্ঞেস করো না, যা তোমাদের কাছে পরিব্যক্ত হলে তোমাদের খারাপ লাগবে। যদি কোরআন অবতরণকালে তোমরা এসব বিষয় জিজ্ঞেস কর, তবে তা তোমাদের জন্যে প্রকাশ করা হবে। অতীত বিষয় আল্লাহ ক্ষমা করেছেন আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল। এরূপ কথা বার্তা তোমাদের পুর্বে এক সম্প্রদায় জিজ্ঞেস করেছিল। এর পর তারা এসব বিষয়ে অবিশ্বাসী হয়ে গেল। (সুরা মায়েদাঃ ১০১-১০২)
ইসলামী শরিয়তের অনুসারীদের কাছে এটা স্পষ্ট যে, শরিয়তের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই হলো মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা বাস্তবায়ন করা। কেননা ইহা মানুষের জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে সর্বযুগে ও স্থানে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও হিতকর জিনিস বাস্তবায়ন করে, আর অকল্যাণ ও ফিতনা ফাসাদ দূর রাখে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭)
রহমত হচ্ছে কল্যানকর প্রয়োজন মিটানোর জন্য কেননা রহমত দ্বারা মানুষের প্রয়োজন মিটানো উদ্দেশ্য না হলে রাসুল (সাঃ) কে রহমত বলা হতনা। শরিয়তের সব আদেশ নিষেধ বান্দাহর দুনিয়া ও আখেরাতের প্রয়োজন ও চাহিদা মিটানোর জন্যই। কেননা আল্লাহ তায়া’লা বান্দাহদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন। তাদের আনুগত্য তাঁর কোন উপকার বা কাজে আসেনা, আবার বান্দাহর নাফরমানীও তাঁর কোন ক্ষতি সাধন করতে পারেনা। ইসলামী শরিয়ত পুরোটাই ন্যায়নীতি, রহমত, মানুষের চাহিদা ও হেকমতের উপর প্রতিষ্ঠিত। যা কিছুই ন্যায় থেকে বেরিয়ে অন্যায় ও জুলুম হয়, রহমতের ব্যাতক্রম হয়এবং প্রয়োজন ও চাহিদার পরিবর্তে ফিতনা ফাসাদ ও হিকমতের পরিবর্তে অযাচিত কাজ হয় তা ইসলামী শরিয়তের অন্তর্ভূক্ত নয়।
ন্যায় বিচার ও সকলের মাঝে সমতা বিধানের সাধারণ নিয়ম হিসেবে অসংখ্য আয়াত এসেছে। একদিকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকে আহবান করেছে, অন্যদিকে জুলুম থেকে দূরে থাকতে বলেছে, যদিও তা প্রতিপক্ষের ব্যাপারে হোক। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত। (সূরা মায়েদাঃ ৮)
ইসলাম সঠিক ধর্ম ও রিসালাত হওয়ার অন্যতম প্রমাণ হলো ইহা অন্যান্য ধর্মের চেয়ে ব্যাপক ও পরিপূর্ণ। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি কোন কিছু লিখতে ছাড়িনি। (সূরা আন’আমঃ ৩৮)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃআমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ। (সূরা নাহলঃ ৮৯)
ইহার ব্যাপকতা স্পষ্ট হয় ইহার আক্বীদা ও চিন্তার ধরণে, ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্যে, আখলাক ও গূণাবলীতে , শরিয়তের বিধি বিধানে, বরং মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ইহা প্রতীয়মান হয়।
ইসলাম সমতা, উদারতা ও ন্যায়পরায়নতার ধর্ম। এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি। (সূরা বাকারাঃ ১৪৩)
এর সব আহকামে রয়েছে সুক্ষ্ম পরিমাপ ও সমতা।
তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদন্ড। (সূরা রহমানঃ ৭)
আল্লাহ তায়া’লা মুসলমানদেরকে সব কাজে সমতা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এবং তারা যখন ব্যয় করে, তখন অযথা ব্যয় করে না কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। (সূরা ফোরকানঃ ৬৭)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কাজে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “সাবধান! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা, কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে”। তিনি সমতা বিধান ও প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ নিশ্চয়ই তোমার রবের প্রতি রয়েছে তোমার হক, তোমার নিজের প্রতি রয়েছে তোমার হক, তোমার পরিবার পরিজনের প্রতিও রয়েছে তোমার হক, তাই প্রত্যেক হকের অধিকারীকে তার হক আদায় করে দাও”।