ইসলামের শরিয়ত, আক্বীদা, আহকামসমূহ খোদা প্রদত্ত ওহী কোরআন ও হাদিস থেকে উৎসারিত। এ দুটো ইসলামের মূল উৎস। এদুটো থেকেই শরিয়তের বিধিবিধান, আক্বীদা ও অন্যান্য আহকাম নেয়া হয়। নিম্নে এ দু’য়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া হলোঃ
আল্লাহ তায়া’লা মুত্তাকিদের হেদায়েত, মুসলমানদের সংবিধান, তিনি যাদেরকে হেদায়েত দিতে চান তাদের অন্তরের আরোগ্যতা ও যাদের কল্যাণ চান তাদের জন্য আলোকবর্তীকা স্বরূপ আল কোরআন তাঁর রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল করেছেন। সমস্ত নবী রাসুলগণ যেসব মূলনীতি নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন সেসব মূলনীতিসমূহ এতে শামিল হয়েছে। আল কোরআন কোন নতুন গ্রন্থ নয়, এমনিভাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও কোন নতুন রাসুল নন। আল্লাহ তায়া’লা ইব্রাহিম (আঃ) এর উপর সহীফা নাযিল করেছেন। মূসা (আঃ) কে তাওরাত দিয়ে সম্মানিত করেছেন। দাউদ (আঃ) কে যাবুর ও ঈসা (আঃ) কে ইঞ্জিল দিয়ে সম্মানিত করেছেন। এ সব কিতাবসমূহ আল্লাহ তায়া’লার ওহী যা তিনি আম্বিয়া কিরামদের নিকট পাঠিয়েছেন। আল কোরানও এসবের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়। সমস্ত নবী রাসুলদের উপর ঈমান আনতেও নির্দেশ দেয়, তাদের মাঝে কোন ধরণের পার্থক্য করতে বারণ করেছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যারা আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী তদুপরি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি কিন্তু কতককে প্রত্যাখ্যান করি এবং এরই মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যাকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছি অপমানজনক আযাব। আর যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর রসূলের উপর এবং তাঁদের কারও প্রতি ঈমান আনতে গিয়ে কাউকে বাদ দেয়নি, শীঘ্রই তাদেরকে প্রাপ্য সওয়াব দান করা হবে। বস্তুতঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু। (সূরা নিসাঃ ১৫০-১৫২)
কিন্তু এসব পবিত্র গ্রন্থসমূহের অনেকটাই কালের অবর্তমানে হারিয়ে গেছে, অধিকাংশগুলোই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। উহাতে নানা পরিবর্তন ও রূপান্তর প্রবিষ্ট হয়েছে।
আর কোরআন শরিফের হেফাযতের দায়িত্ব মহান আল্লাহ তায়া’লা নিজেই নিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজরঃ ৯)
তিনি কোরানকে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের রক্ষক ও রহিতকারী করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববতী গ্রন্থ সমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। (সূরা মায়েদাঃ ৪৮)
তিনি কোরআনকে সব বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ। (সূরা নাহলঃ ৮৯)
ইহাতে রয়েছে হেদায়েত ও রহমত। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ অতএব, তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুষ্পষ্ট প্রমাণ, হেদায়েত ও রহমত এসে গেছে। (সূরা আন’আমঃ ১৫৭)
ইহা সরল ও সৎকর্ম পরায়ণশীলদেরকে পথ প্রদর্শন করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে। (সূরা বনী ইসরাইলঃ ৯)
ইহা মানব জীবনের সব বিষয়ের সরল সঠিক ও সুন্দর সমাধান দিয়েছে।
মানুষ যা কিছু প্রয়োজনবোধ করে তার সব কিছুই কোরআনে শামিল করা হয়েছে। ইহাতে আইন কানুন, আক্বীদা, আহকাম, লেনদেন, শিষ্টাচারের মৌলিক সব নীতি শামিল করা হয়েছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি কোন কিছু লিখতে ছাড়িনি। (সূরা আন’আমঃ ৩৮)
আল্লাহ তায়া’লা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট কোরআন নাযিল করেছেন, তিনি তাঁর কাছে হাদিসসমূহও ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ কোরআন ওহী,যা প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা নাজমঃ ৪)
ইহা কোরআনেরই অনুরূপ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে লোকসকল! আমাকে কিতাব দান করা হয়েছে, ইহার অনুরূপ আরো একটি কিতাব দান করা হয়েছে”। (মুসনাদে আহমদ)। অতএব, হাদিস শরিফ আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ থেকে রাসুলের নিকট ওহী। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও নিজের থেকে বানিয়ে কোন কথা বলতেন না। আল্লাহ তায়া’লা তাকে যা নির্দেশ দিয়েছেন তিনি শুধুমাত্র তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি কেবল তারই অনুসরণ করি, যা আমার প্রতি ওহী করা হয়। আমি স্পষ্ট সতর্ক কারী বৈ নই। (সূরা আহক্বাফঃ ৯)
হাদিস হলো ইসলামের দ্বিতীয় মূল উৎস। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালামের থেকে সহীহ ধারাবাহিক সনদে যে সব কথা, কাজ, বর্ণনা বা মৌন সম্মতি এসেছে উহাকে হাদিস বলে। ইহা কোরানের ব্যাখ্যাকার ও স্পষ্টকারী। আল্লাহ তায়া’লা তার রাসুলকে কোরআনের আ’ম (ব্যাপকতা), খাস (নির্দিষ্টতা), মুজমাল (অস্পষ্টতা) ইত্যাদি ব্যাখ্যা করতে অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনার কাছে আমি স্মরণিকা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিবৃত করেন, যে গুলো তোদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা নাহলঃ ৪৪)
অতএব হাদীস কোরআনের ব্যাখ্যাকারী, কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যাদান করে। অস্পষ্ট আহকামের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। যেহেতু রাসুলের নিকট যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তিনি সেগুলোর কখনো কথার মাধ্যমে, কখনও কাজের মাধ্যমে বা কখনও কথা ও কাজ উভয়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কোরআন ছাড়াও হাদিস শরিফ স্বতন্ত্রভাবে কিছু কিছু বিধি বিধান প্রণয়ন করেছে।
অতএব হাদিস হলো ইসলামের বিধি বিধান, আক্বীদা, ইবাদত, লেনদেন ও শিষ্টাচারের ব্যবহারিক প্রয়োগ। আল্লাহ তায়া’লা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যা নির্দেশ দিয়েছেন তা তিনি ব্যবহারিকভাবে দেখিয়েছেন, মানুষকে ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি যেভাবে করেছেন মানুষকে সেভাবে করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা মুমিনদেরকে রাসুলের কথাবার্তা ও কাজের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তাদের ঈমান পরিপূর্ণ হয়। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সূরা আহযাবঃ ২১)
সাহাবায়ে কিরামগণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালামের কথা, কাজ তাদের পরবর্তীদের জন্য বর্ণনা করে গেছেন। পরবর্তীরা (তাবেঈগণ) তাদের পরবর্তীদের জন্য বর্ণনা করে গেছেন। অতঃপর হাদিসের কিতাবে তা লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। হাদিসের বর্ণনা খুব সতর্কতার সাথে সম্পন্ন হয়েছে, যারা উহা বর্ণনা করছেনতাঁরা বর্ণনাকারীদের পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ হওয়া সম্পর্কে জেনে নিতেন। এমনিভাবে হাদিসের সনদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। সনদের সকল মুহাদ্দিসগণ সিকাহ (নির্ভরযোগ্য),আদেল (ন্যায়পরায়ন), ও আমিন (বিশ্বস্ত) ছিলেন। ইসলামের মূল উৎস হিসেবে কোরআন ও হাদিসের উপর ঈমান আনা ফরজ, উভয়ের উপর আমল করা, এদু’য়ের দিকে প্রত্যাবর্তন করা, উহার আদেশসমূহ মান্য করা ও নিষেধসমূহ থেকে বিরত থাকা ফরজ। উহাতে যেসব বিষয়ে সংবাদ দেয়া হয়েছে তাতে বিশ্বাস করা, আল্লাহর নাম, সিফাত ও কাজের ব্যাপারে যা কিছু বলা হয়েছে, মুমিনদের জন্য আল্লাহ পাক যে পুরস্কার ও কাফিরদের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন ইত্যাদিতে বিশ্বাস স্থাপন করা সবার জন্য ফরজ। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে। (সূরা নিসাঃ ৬৫)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক। (সূরা হাশরঃ ৭)
অতএব, হে শান্তির পথের দিশারী, যারাই শান্তির পথে চলতে চাও এসো, ইসলামের দিকে এসো, ইহাই একমাত্র শান্তির পথ!!!