ইসলামী সভ্যতার কতিপয় স্বতন্ত্র উপাদান রয়েছে, যা একে আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও সুস্পষ্ট গুনাবলীতে উজ্জ্বল করে রেখেছে যা অন্যান্য সভ্যতার মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্যে ও মৌলিক নীতি হতে আলাদা করে ব্যাক্তিত্ব সৃষ্টি করে।যদিও এর কতিপয় উপাদান অন্যান্য সভ্যতার মাঝেও বিদ্যমান।
ইসলামী সভ্যতার মূল ভিত্তি জ্ঞান-বুদ্ধিকে অতিসম্মান দেয়া নয়, যেমনটি গ্রীকরা করত। শক্তি, প্রভাব ও কর্তৃত্বের অতিমর্যাদা নয়, যেমনটি রোমানরা করত। ইহা দৈহিক ভোগবিলাস, সমর শক্তি, ও রাজনৈতিক দাপটকে অতিগুরুত্ব দেয়নি, যেমনটি ছিল পারস্যদের নিকট। আবার শুধু আত্মিক শক্তির সম্মান ও করেনি, যেমনটি হয় হিন্দু ও কতিপয় চীনাদের নিকট। ধর্ম যাজকদেরও কাল্পনিক এবং পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে আলাদা কোন সম্মান ও দাপট নাই, যা মধ্যযুগে ইউরোপকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। এতে বস্তু বিজ্ঞানের বিমোহ নাই বা মহাবিশ্ব ও শুধু পদার্থ নিয়ে শুধু গবেষণাও নাই, যেমনটি করে গ্রীক ও রোমানদের থেকে প্রাপ্ত আধুনিক সভ্যতা। ইসলামী সভ্যতার মূল হলো তাওহীদ, চিন্তা-গবেষণা, বিজ্ঞান, কর্ম, আত্মা, আবাদ, বিবেকের মর্যাদা ও মানুষকে সম্মান দেয়া, এককথায় মানবের জীবনে যা কিছু দরকার সব কিছুই ইসলামী সভ্যতার মৌলিক উপাদান। এভাবেই ইসলামী সভ্যতা স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিপূর্ণ সংবিধান, যা অন্যান্য সভ্যতার মৌলিক উপাদানের সাথে মূলেই ভিন্ন।
ইসলামী সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতা থেকে উন্নত এজন্য যে, শত্রুর সাথে ইহার রয়েছে আত্মিক জিহাদ ও পরিশ্রম, ন্যায্যতা, ন্যায়বিচার ও ক্ষমার আদর্শ, বিশ্বের সকলের জন্য রয়েছে কল্যাণের প্রতি ভালবাসা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার। এজন্য ইহা আবার তার অনন্য উপাদানের দ্বারা মানব জাতিকে পরিচালনার জন্য নির্বাচিত।
ইসলামী সভ্যতা কতিপয় বৈশিষ্ট্য ও উপাদানে আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, সেগুলো হলোঃ
সুখ-শান্তি লাভের মূল হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। ইহা জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতা গঠনের মূল নিয়ামক। যে সব সভ্যতা আল্লাহর উপর ঈমান ও তাঁর তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তা অন্তঃকলহ, পরষ্পর বিবাদে লিপ্ত। একটি অন্যটিকে ধ্বংস করে দেয়। কেননা সেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য ইলাহদেরকে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর ইহা মানুষের জীবনকে বিনষ্ট করে দেয়, দুঃখ-দুর্দশা বয়ে আনে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যদি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকত, তবে উভয়ের ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র। (সূরা আম্বিয়াঃ ২২)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সাথে কোন মাবুদ নেই। থাকলে প্রত্যেক মাবুদ নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে চলে যেত এবং একজন অন্যজনের উপর প্রবল হয়ে যেত। তারা যা বলে, তা থেকে আল্লাহ পবিত্র। (সূরা মু’মিনূনঃ ৯১)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলুনঃ তাদের কথামত যদি তাঁর সাথে অন্যান্য উপাস্য থাকত; তবে তারা আরশের মালিক পর্যন্ত পৌছার পথ অন্বেষন কর। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৪২)
আধুনিক ও পূর্বের অনেক সভ্যতায় এ সবের প্রতিফলন দেখা যায়। তারা যা প্রত্যাশা করে তার বিপরীতটা হয়ে থাকে। তারা যেসব বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেয়া ফলাফল দাঁড়ায় উল্টোটা, ফলে মানবজাতিকে তারা দুঃখ-দুর্দশার দিকে টেনে নিয়ে যায়, যদিও তারা তাদের জন্য ভালই কামনা করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তারা তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদিগকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে আল্লাহ ব্যতীত এবং মরিয়মের পুত্রকেও। অথচ তারা আদিষ্ট ছিল একমাত্র মাবুদের এবাদতের জন্য। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তারা তাঁর শরীক সাব্যস্ত করে, তার থেকে তিনি পবিত্র। (সূরা তাওবাঃ ৩১)
ইসলাম বিশ্বব্যাপী ধর্ম, যা সর্বযুগে, স্থানে, প্রত্যেক ভাষাভাষী, গোত্র-জাতি, বর্ণ সকলের জন্যই প্রযোজ্য ও উপযোগী। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (সূরা সাবা’ ২৮)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ পরম কল্যাণময় তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ অবর্তীণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হয়। (সূরা ফুরকানঃ ১)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলে দাও, হে মানব মন্ডলী। তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহ প্রেরিত রসূল, সমগ্র আসমান ও যমীনে তার রাজত্ব। (সূরা আ’রাফঃ ১৫৮)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭)
ইসলাম চিরন্তন আক্বীদা নিয়ে এসেছে যা কোন অবস্থাতেই পরিবর্তন হবেনা। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে উপযোগী ন্যায়নীতি, সৎ ও কল্যাণকর মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত শরিয়ত নিয়ে এসেছে, যা সর্বস্থানে ও যুগে উপযোগী। এছাড়া আল্লাহ তায়া’লাই সর্বজ্ঞ, কিসের মাঝে তাঁর সৃষ্টিকুলের জন্য কল্যাণ রয়েছে তা একমাত্র তিনিই জানেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি করে জানবেন না? তিনি সূক্ষ্নজ্ঞানী,সম্যক জ্ঞাত। (সূরা মুলকঃ ১৪)
এমনিভাবে ইসলাম শুধু কতিপয় গোষ্ঠী, বর্ণ, বা নির্দিষ্ট কোন জাতির ধর্ম নয়। ইহা সাদা, কালো, হলদে, লাল সব মানুষেরই ধর্ম। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকল প্রজন্মেরই ধর্ম। কোন গবেষকই ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনিত এ ধর্মে আঞ্চলিকতা, গোত্রীয়তা ও বর্ণবাদ কখনও পাবেনা, সে যতই গবেষণা করুক, আর তাকে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি দান করা হোক। ইহাই স্পষ্ট প্রমাণ যে, ইসলাম হলো বিশ্বজনীন দাওয়াত, ইহা কোন নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। যেহেতু ইসলামের নীতিমালা, শরিয়াত, আহকাম ও আখলাক সব কিছুই সকল মানুষের জন্য সর্বযুগে ও স্থানে উপযোগী।
অতএব, আমরা একথা বলতে পারিনা যে, ন্যায় বিচার বা সুন্দর আচরণ কোন কোন জাতির ক্ষেত্রে বা কোন যুগে উপযোগী নয়। ইহা শুধু ইসলামের জন্যই খাস। অন্যদিকে কিছু ধর্মে আঞ্চলিকতা, গোত্রীয়তা বা জাতীয়তা স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ইহুদীরা তাদের ধর্মের লোক ছাড়া অন্যান্যদের সাথে যখন লেনদেন ও আচরণ করে সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ কোন কোন আহলে কিতাব এমনও রয়েছে, তোমরা যদি তাদের কাছে বহু ধন-সম্পদ আমানত রাখ, তাহলেও তা তোমাদের যথারীতি পরিশোধ করবে। আর তোদের মধ্যে অনেক এমনও রয়েছে যারা একটি দীনার গচ্ছিত রাখলেও ফেরত দেবে না-যে পর্যন্ত না তুমি তার মাথার উপর দাঁড়াতে পারবে। এটা এজন্য যে, তারা বলে রেখেছে যে, উম্মীদের অধিকার বিনষ্ট করাতে আমাদের কোন পাপ নেই। আর তারা আল্লাহ সম্পর্কে জেনে শুনেই মিথ্যা বলে। (সূরা আলে ইমরানঃ ৭৫)
মানুষ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো আল্লাহ তায়া’লা তাদেরকে জমিনের আবাদ কর্মে খলিফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তিনিই যমীন হতে তোমাদেরকে পয়দা করেছেন, তন্মধ্যে তোমাদেরকে বসতি দান করেছেন। (সূরা হুদঃ ৬১)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্বীয় প্রতিনিধি করেছেন। অতএব যে কুফরী করবে তার কুফরী তার উপরই বর্তাবে। কাফেরদের কুফর কেবল তাদের পালনকর্তার ক্রোধই বৃদ্ধি করে এবং কাফেরদের কুফর কেবল তাদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। (সূরা ফাতিরঃ ৩৯)
যে সব জ্ঞান মানব জাতির কোন না কোন উপকারে আসে বা জমিনের আবাদ কার্যে লাগে সে জ্ঞান সকলে ছেড়ে দিলে সবাই গুনাহগার হবে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক সময় প্রেরিত হয়েছিলেন যখন মানব জাতি সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে ছিল। যখন মানুষ সমাজ গঠন, কাজকর্ম ও জমিনের আবাদ কাজ ছেড়ে অনর্থক দর্শন, তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-ঝাঁটির মাঝে লিপ্ত থাকত। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানব জাতিকে এ সব কর্ম থেকে মুক্ত করলেন, তাদের মর্যাদা উঁচু করলেন, তাদেরকে তিনি ইসলাম ধর্ম দিয়ে মর্যাদাবান করেছেন। ইহা সভ্যতা, উন্নয়ন ও সমাজ বিনির্মানের ধর্ম। এতে সমাজ উন্নয়ন ও আত্মিক আলোকদীপ্ততার মাঝে কোন বিরোধ নেই। তাই মুসলমানের অন্তরে ইবাদত ও পার্থিব কাজের মাঝে এবং পৃথিবীর উন্নয়ন কাজের সাথে আত্মিক জীবন ও আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজের কোন বৈপরিত্য নেই। বরং সব কাজই আল্লাহর জন্যই এবং তাঁরই নির্দেশিত পথে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। (সূরা আন’আমঃ ১৬২)
ইসলামে শিষ্টাচার হলো ইবাদত। বরং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যই হলো মহান চরিত্রকে পরিপূর্ণ করা। তিনি বলেছেনঃ “আমি সুন্দর চরিত্রকে পরিপূর্ণ করতে প্রেরিত হয়েছি”। (বর্ণনায় ইমাম মালিক রাঃ)। অতএব, সভ্যতা ও সুখ-শান্তির পথ হলো শিষ্টাচার ও নৈতিকতার পথ, যাতে সুন্দর চরিত্র ও উত্তম কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়।
ইসলামে আখলাক জীবনের সব ক্ষেত্রকেই শামিল করে। যেমনঃ মানুষ নিজের সাথে ব্যবহার, আল্লাহর সাথে ও অন্যান্যদের সাথে তার আচার ব্যবহার ইত্যাদি সব কিছুই শামিল করে। এমনিভাবে মুসলমান-কাফির, ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা ও স্বপক্ষ-বিপক্ষ সকলের সাথে আচার ব্যবহার আখলাকের মধ্যে শামিল। ইসলাম অন্যের সাথে আচার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বদান্যতা, বীরত্ব, ন্যায়নীতি, রহমত, নম্রতা, উত্তম শিষ্টাচার, সততা, লজ্জাশীলতা, ধৈর্য, বিশুদ্ধ অন্তর ও ভাল কাজের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদির নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তায়া’লা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমনকি বিপক্ষ লোকের বেলায়ও নির্দেশ দিয়ে বলেছেনঃ হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত। (সূরা মায়েদাঃ ৮)
তিনি তাঁর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত ও বিশ্বব্যাপী সকলের জন্য তাঁকে রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইহা শুধু ঈমানদারদের জন্য খাছ নয়। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭)
ইসলামী সভ্যতায় এ আখলাকসমূহ অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আলাদা করা যায়না এবং ইহা ইসলামী সভ্যতার মূল ভিত্তি। অতএব, পৃথিবীর আবাদ কার্যে, বা কোন স্বার্থে বা অন্য কোন কারণে মুসলমানের থেকে এ সব সুন্দর আখলাকসমূহ কোনভাবেই চলে যেতে পারেনা। আল্লাহ তায়া’লা তাঁর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বকাজের ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ ও অনুপম নমুনা করতে সুন্দর শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সূরা আহযাবঃ ২১)
একে তিনি তাঁর রহমতের একটি অংশ ও শান্তির পথে মানুষের হিদায়েতের উদ্বুদ্ধকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল,দয়াময়। (সূরা তাওবাঃ ১২৮)
ইসলাম ধর্মে পৌরহিত্যের কোন স্থান নেই, যাকে কোন প্রশ্ন করা যাবেনা, বা কোন গোপনীয় রহস্য সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করা যাবেনা। বরং আল্লাহ তায়া’লা তাঁর নিদর্শনাবলী, সৃষ্টি ও অন্যান্য জাতির ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও। (সূরা আলে ইমরানঃ ১৯১)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেছেনঃ এমনিভাবে আমি খোলাখুলি বর্ণনা করে থাকি নিদর্শণসমূহ সে সমস্ত লোকদের জন্য যারা লক্ষ্য করে। (সূরা ইউনুসঃ ২৪)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেছেনঃ প্রেরণ করেছিলাম তাদেরকে নির্দেশনাবলী ও অবতীর্ণ গ্রন্থসহ এবং আপনার কাছে আমি স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিবৃত করেন, যে গুলো তোদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা নাহলঃ ৪৪)
আল্লাহ তায়া’লা বলেছেনঃ তারা কি তাদের মনে ভেবে দেখে না যে, আল্লাহ নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথরূপে ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, কিন্তু অনেক মানুষ তাদের পালনকর্তার সাক্ষাতে অবিশ্বাসী। (সূরা রূমঃ ৮)
আল্লাহ তায়া’লা বলেছেনঃ আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্যে বর্ণনা করি, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা হাশরঃ ২১)
বরং আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, ইলম বা জ্ঞান শুধু ধারণা করা নয়, বরং এ ব্যাপারে তার অকাট্য দলিল প্রমাণ থাকতে হবে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলে দিন, তোমরা সত্যবাদী হলে, প্রমাণ উপস্থিত কর। (সূরা বাকারাঃ ১১১)
অতএব, ইসলামে এমন কোন রহস্য নেই যা কেউ জানেনা, বা এমন কোন গোপনীয়তা নেই যা পৌরহিত ছাড়া কেউ জানেনা।
অভ্যন্তরীণ শান্তি বলতে মানুষের মনের শান্তি ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ থেকে মুক্ত হওয়াকে বুঝায়, আধুনিক সভ্যতায় মানুষ এ সব সমস্যার খুব সম্মুখীন হয়। কিন্তু ইসলামে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতের চিন্তা ভাবনা নিয়ে বসবাস করে। ইবাদত, দুনিয়ার কাজকর্ম ও নির্মাণ একই সাথে করে থাকে, পার্থিবতা ও আধ্যাত্মিকতা, বিজ্ঞান ও ধর্ম একই সাথে সহাবস্থানে বাস করে। এ সবের মাঝে কোন বিরোধ নেই। ইসলামী সভ্যতায় অভ্যন্তরীণ শান্তি একটি স্পষ্ট নিদর্শন, যা তাওহীদ হতে উৎসারিত, মুসলমানের অন্তরে যা কিছুই আসে সব কিছুই সহজ ও সুন্দরভাবে সুবিন্যাস্ত করে দেয়। ইসলামে দুনিয়া মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নয়, বরং ইহা আখেরাতের জন্য শস্য ক্ষেত্র ও পথ ও খেয়া স্বরূপ। ইহা আল্লাহ তায়া’লার নিম্নোক্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়ঃ আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভূলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা কাসাসঃ ৭৭)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর,যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা জুম’আঃ ১০)
অর্থাৎ যখন নামাজ সমাপ্ত হবে তখন দুনিয়ার কাজে ছড়িয়ে পড়, যতক্ষণ পর্যন্ত তা হালাল উপার্জন হয়। আর এতে ইখলাস অন্বেষণ কর, আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর। যেমন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবাদেরকে বলেছেনঃ “তুমি যা কিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টিতে ব্যয় করবে তাতেই প্রতিদান পাবে, এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও তার জন্যও। ”। (ইমাম মালিক এটি বর্ণনা করেছেন।) অর্থাৎ তোমার স্ত্রীর মুখে যা দাও তাতেও সাওয়াব পাবে। অতএব আমাদের দুনিয়ার কোন কাজই আখেরাতের থেকে আলাদা নয়। তবে শর্ত হলো আখেরাতকে ছেড়ে শুধু দুনিয়ার মাঝে ডুবে থাকা যাবেনা। যেমন আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা মুনাফিকূনঃ ৯)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভূলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। (সূরা কাসাসঃ ৭৭)
কাজের প্রতি ভালবাসা, স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা, ছেলে সন্তানদের সাথে আনন্দ করা ও তাদের প্রতি গুরুত্ব দেয়া ইত্যাদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরিয়তের নির্দেশিত পথে করলে দ্বীন ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। (সূরা আন’আমঃ ১৬২)
মানুষের পুরা জীবনই আল্লাহ তায়া’লার জন্য, এমনকি যাতে মানুষের নফসের ইচ্ছা মিটে নিয়্যাত বিশুদ্ধ হলে তাও আল্লাহর আনুগত্য হবে।
বাহিরের শান্তি হলো স্বপক্ষ বা বিপক্ষ নিকটতম ও দূরতম সকল মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। এক মুসলিমের সাথে অন্য মুসলিমের সাক্ষাতে ইসলামের প্রথম অভিবাদনই হলোঃ “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ” অর্থঃ আপনার উপর শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকত নাযিল হোক। ইসলামী শাসনের যুগে সমস্ত ধর্ম যেরূপ সুখী ও নিরাপদ ছিল অন্য কোন যুগে সেরূপ আর আসেনি। মুসলমানের পতনের কারণে বিশ্ব কত কিছুইনা হারালো। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যারা পবিত্র মসজিদ থেকে তোমাদেরকে বাধা প্রদান করেছিল, সেই সম্প্রদায়ের শুত্রুতা যেন তোমাদেরকে সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা। (সূরা মায়েদাঃ ২)
ইসলামী সভ্যতা তার প্রত্যেক সদস্যের উপর স্বচ্ছ ও পরিস্কার হৃদয়ের অধিকারী হওয়া অত্যাবশ্যকীয় করে। আল্লাহ তায়া’লা মু’মিনদের দোয়া সম্পর্কে বলেনঃ আর এই সম্পদ তাদের জন্যে, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে এবং ঈমানে আগ্রহী আমাদের ভ্রাতাগণকে ক্ষমা কর এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের পালনকর্তা, আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়। (সূরা হাশরঃ ১০)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না, কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে। (সূরা শুআ’রাঃ ৮৮-৮৯)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা পরস্পর বিরোধে লিপ্ত হয়োনা, পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ করোনা, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করোনা, বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে থেকো। কোন মুসলমানের জন্য তিন দিনের বেশী তার ভাইকে পরিত্যাগ করে থাকা জায়িয নয়; এভাবে যে, তারা মিলিত হলে একে অন্যের থেকে ফিরে থাকবে, তাদের মধ্যে উত্তম সেজন যে প্রথমে সালাম দিবে”। (মুসলিম শরীফ)। রাসুল (সাঃ) ভালবাসা ও অন্তরঙ্গতা সম্পর্কে বলেছেনঃ “যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, তোমরা ঈমান আনা ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবেনা, আর যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পরস্পরকে ভাল না বাসবে ততক্ষণ পরিপূর্ণ ঈমানদার হবেনা। আমি কি বলে দিব না কোন জিনিস তোমাদের জন্য এগুলোকে দৃঢ় করবে? তোমরা নিজেদের মাঝে বেশী বেশি সালামের প্রচলন কর”। (তিরমিজি শরীফ)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো কোন ব্যক্তি উত্তম? তিনি বললেনঃ প্রত্যেক মাখমুম (পরিচ্ছন্ন) অন্তর, সত্যবাদী জবান। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেনঃ সত্যবাদী জবান আমরা চিনি, কিন্তু মাখমুম অন্তর বলতে কি বুঝায়? তিনি বললেনঃ প্রত্যেক স্বচ্ছ ও পবিত্র অন্তর, তাতে কোন গুনাহ বা পাপ নেই, সীমালঙ্ঘন, আত্মসাৎ ও হিংসা বিদ্বেষ নেই”। (ইবনে মাজাহ শরিফ)।
ইসলামী সভ্যতা আধ্যাত্মিকতার আলো নিয়ে আসলেও একই সময়ে পার্থিব বিষয়কে ভুলে যায়নি বা অবহেলা করেনি। আল্লাহ তায়া’লা মানুষকে দেহ ও রূহ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। জীবন যাপনের জন্য মানুষের দৈহিক ও আত্মিক দিকের সব উপাদান দিয়ে দিয়েছেন। শরীরের জন্য সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন, যাতে সে পৃথিবীতে বসবাস করতে পারে। আত্মার খাদ্য হিসেবে নবী রাসুলদের মাধ্যমে আসমানী অহী নাযিল করেছেন। মানুষকে দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ তায়া’লা বলেছেনঃ আর আপনার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদেরকে বললেনঃ আমি পচা কর্দম থেকে তৈরী বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্ট একটি মানব জাতির পত্তন করব। অতঃপর যখন তাকে ঠিকঠাক করে নেব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফঁুক দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় পড়ে যেয়ো। (সূরা হিজরঃ ২৮-২৯)
রূহ ও শরীর পরস্পর মিশ্রিত, যা মৃত্যু ছাড়া একে অন্য থেকে আলাদা হয়না। রূহ ও শরীরের আলাদা আলাদা চাহিদা রয়েছে। খাদ্য, পানীয় এবং পোশাক পরিচ্ছেদের মাধ্যমে শরীর বেঁচে থাকে। যদি এর একটিও অপূর্ণ করি তবে পুরা শরীরে এর প্রভাব ফেলবে। মানুষ যদি খাদ্য গ্রহণে কমতি করে তাহলে সে দুর্বল ও ধ্বংসের দিকে যাবে, সে সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করতে পারবেনা। এমনিভাবে পানীয় ও পোশাক পরিচ্ছেদও।
শরীরের কোন একটি চাহিদা অপূর্ণ রাখলে এর প্রতিফলন পুরা শরীরে পড়ে, সে জীবনধারণে শক্তি পায়না, সুখ-শান্তির জীবন যাপনে জীবনের অন্য অংশেরও সাহায্য করতে পারেনা। এমনিভাবে রূহেরও রয়েছে কতিপয় চাহিদা। ভালবাসা, বদান্যতা ও আত্মত্যাগ ছাড়া রূহ বাচঁতে পারেনা। রূহ কিভাবে বাঁচবে সে যদি এমন একজন প্রভু না পায় যার ইবাদত করবে, যাকে ভালবাসবে, তার নিকট প্রত্যাশা করবে, তাঁকে ভয় করবে, তার নিকট প্রত্যাবর্তন করবে?! রূহ কিভাবে বাঁচবে যদি উহা শূন্য হৃদয় হয়, কারো উপর ভরসা ও কারো নিকট শান্তি লাভ না করতে পারে। অথবা যদি নিরাপত্তা, বদান্যতা, অন্তরের শান্তি, মানুষের মাঝে ভালবাসা না পায়?! মানুষ যদি রূহের চাহিদাগুলো পূর্ণ না করে তাহলে সে যেমন তার খাদ্য ও পানীয়তে ত্রুটি করল। কিভাবে মানুষের অবস্থা শান্ত হবে? তার অবস্থা কিভাবে স্থির হবে তার অন্য অর্ধেক যদি ব্যথায় আক্রান্ত হয়?! দুঃখের বিষয় হলো পশ্চিমা সভ্যতা রূহের আনন্দ খুশীর ব্যাপারটা ভুলে গেছে, ফলে তারা ভোগ বিলাসের চরম পর্যায়ে পৌঁছলেও দুনিয়াতে দুর্ভাগা ও দুঃখী। আধুনিক সভ্যতা শরীর ও পার্থিব সেবায় অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, কিন্তু সে ভুলে যায় যে, রূহ ছাড়া শরীরের কোন সুখ, সফলতা, আনন্দ ও প্রশান্তি আসতে পারেনা। বরং এটাকে কোন সভ্যতাই বলা যায়না।
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, মানবাধিকার বাস্তবায়ন করাই কোন রাষ্ট্রের ন্যায়নীতি, ইনসাফ, দেশের মানুষের অধিকার রক্ষা ও তাদের স্বাধীনতার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। ইহা উক্ত জাতির জ্ঞান গরিমা ও সচেতনতার মাপকাঠি। বরং গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মানবাধিকার রক্ষা করা।
ইসলামী সভ্যতা পৃথিবীর বুকে বাস্তবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এক মহা উপমা ও নমুনা প্রবর্তন করেছে। ইহা ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব, কেননা ইহা শুধু কথা বা শ্লোগানে সীমাবদ্ধ নয়। এজন্যই ইসলামে অন্যতম মানবাধিকার হলো নিম্নরূপঃ
ইসলামে মানবাধিকারের মূল ভিত্তি হলো সার্বভৌমত্ব ও শাসন হলো একমাত্র মহান আল্লাহ তায়া’লার। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ ছাড়া কারো নির্দেশ চলে না। তিনি সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠতম মীমাংসাকারী। (সূরা আন’আমঃ ৫৭)
ফলে ইসলামী প্রকল্পে অধিকারের ক্ষেত্রে সৃষ্টির প্রতি ও তার প্রয়োজনের প্রতিআল্লাহ তায়া’লার দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা হয়।
স্থায়ীত্বঃ স্থান, কাল, সমস্যা ও অবস্থার পরিবর্তনের কারণে এ অধিকার পরিবর্তীত হয়না।
অধিকারকে ইহসান ও ইখলাসের স্থান থেকে বিবেচনা করা। ইসলামে অধিকার সে স্থান থেকে উৎসারিত যেখানে বান্দাহ আল্লাহ তায়া’লার ভয় ও আশঙ্কায় থাকে, ইহাই রাসুলের (সাঃ) কথা অনুযায়ী ইহসানের দরজা। তিনি বলেছেনঃ “ ইহসান হলো তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে কর যেন তুমি তাঁকে দেখতেছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পারো তবে তিনি তো তোমাকে দেখছেন”। (মুসলিম শরিফ)।
মানবাধিকার ও ধর্মের প্রকৃতির মাঝে সঙ্গতি ও সম্পূরকতাঃ ইসলাম মানুষের জন্য শুধু অধিকার দিয়েই ছেড়ে দেয়নি, ইহা বাস্তবায়নে যথাযথ পরিবেশ ও শরয়ী আহকামের সীমারেখা নির্ধারন ও শরিয়তের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। একে ইসলামের শিষ্টাচার ও আখলাকের সাথে সম্পৃক্ত করেছে। সে সব শিষ্টাচারকে অধিকারের মধ্যে শামিল করে সর্বশেষে দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত করেছে। এরমূল উৎস আল্লাহর পক্ষ হতে গণ্য করেছে। এজন্যই এসব অধিকারকে শুধু অধিকারই নয়, বরং অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে ধরা হয়। তাই ইসলামে অধিকারসমূহ আল্লাহর সৃষ্টি প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও সম্পূরক।
ইসলামে মানবাধিকারের ধরণ হলো, ব্যক্তিগত অধিকার থেকে সমষ্টিক অধিকার উৎসারিত হয়, যা মানব রচিত সমাজ ব্যবস্থার বিপরীত। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এ কারণেই আমি বনী-ইসলাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবাপৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। তাদের কাছে আমার পয়গম্বরগণ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছেন। বস্তুতঃ এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমাতিক্রম করে। (সূরা মায়েদাঃ ৩২)
অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থার আগেই ইসলাম মানবাধিকার দিয়েছেঃ ইসলাম যে সব মানবাধিকার দিয়েছে তা কোন বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘাত বা বিপ্লব বা আন্দোলনের পরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যেমনটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মানবাধিকারের ইতিহাসে দেখা যায়। ফ্রান্স, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে যেভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বরং ইসলামে মানবাধিকারের মৌলনীতি ও আহকাম আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পূর্বের কোন আলোচনা, আন্দোলন বা প্রচেষ্টার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বাস্তবসম্মত, জীবনের সাথে সম্পৃক্ত ও মানুষের প্রয়োজন মিটায়; যা অন্যান্য ব্যবস্থার বিপরীত, কেননা তা দার্শনিক ভাবধারায় চিত্রিত।
ইসলামে একক কতিপয় মানিবাধিকার রয়েছে, যা অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থায় পাওয়া যায়না, যেমনঃ পিতামাতার অধিকার, নিকটতম ও দূরতম আত্মীয়স্বজনের অধিকার, ভ্রূণের অধিকার, ব্যক্তির ধর্মীয় ও পার্থিব শিক্ষার অধিকার, হালাল উপায়ে উপার্জনের অধিকার ও সুদ থেকে বারণ করার অধিকার, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের থেকে নিষেধ করার অধিকার।
ইসলামে মানবাধিকারের মূল হলো সর্বপ্রথম মানুষকে সম্মান করা, আল্লাহর উপর ঈমান আনার মাধমে আবেগময় অনুভূতিকে আলোড়িত করা।অন্যান্য মতবাদ তার ব্যাতিক্রম। এ বিশ্বে যা কিছু মানুষের কল্যাণে অধীনস্থ করে দেয়া হয়েছে তা জীবনের সাথে সংগতিপূর্ন ও পরিপূরক, ইসলামের মানবাধিকারের মূলে এ বিষয়টিও রয়েছে।
ইতিহাসে অন্য কোন সভ্যতাকে দেখা যায়না যা স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে মানবাধিকার বাস্তবায়ন করেছে। কত সহজে মানবাধিকারের সস্তা বুলি, শ্লোগান আর পেষ্টুন উত্তোলন করা যায়, কিন্তু এর আড়ালের প্রকৃত উদ্দেশ্য আর গোপন স্বার্থ অপ্রকাশ্যই থেকে যায়; যখন সন্দেহভাজন লোকেরা সেই তথাকথিত মানবাধিকারের ধ্বজাধারী হয়ে থাকে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র মানব জাতির জন্য সভ্যতা নিয়ে আগমন করয়েছেন; কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের পশ্চাদপসরতা ও অবস্থা দেখলে নানা প্রশ্ন জাগে, অথচ ইসলামী সভ্যতা তাদেরকে কতকিছু দান করেছে?! আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বর্তমানে মুসলমানেরা তাদের দ্বীনের উপর নেই, তাদের অনেকেই ইসলামের মূলনীতি, শিক্ষা ও কোরআন হাদীসের থেকে দূরে সরে গেছে। নতুবা ইসলামী সভ্যতার মত আর কোন সভ্যতাই নাই যা মানব জাতিকে সুখী ও সৌভাগ্যবান করতে পারে। ইতিহাসের পাতায় দেখলে ও উদারমনা ও ন্যায়নীতিবানদের কথা শুনলে এ কথা স্পষ্টই বুঝা যাবে যে, মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কি হারালো?!