আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের সবচেয়ে উপযোগী পন্থা। এতে মানুষের মনে বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। স্রষ্টার মহত্ব, জ্ঞান-গরিমা ও হিকমত জানা যায়। আল্লাহ তায়া’লা আসমান জমিন যথার্থভাবে সৃষ্টি করেছেন, এগুলোকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি। তিনি কোন কিছু নিরর্থক কিছু সৃষ্টি করেন না। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
(আল্লাহ যথার্থরূপে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন। এতে নিদর্শন রয়েছে ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্যে)। (আনকাবুতঃ ৪৪)
এ ধরায় কত যে বিচিত্র প্রাণী রয়েছে যা গণনা করে শেষ করা যাবেনা। এ সব কিছু সৃষ্টির পিছনে কি হিকমত আছে বলে আপনি কি মনে করেন?! এ মহাবিশ্বে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে যা আল্লাহর কুদরত ও তাঁর মহিমা প্রমাণ করে। আধুনিক বিজ্ঞান এখনো অনেক নতুন নতুন নিদর্শন আবিষ্কার করছে যা মানুষকে মহান সুনিপুণ প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা আল্লাহর মহিমা বুঝিয়ে দেয়।
মানুষ যদি এ মহাবিশ্ব ও এর ভিতরে যা কিছু আছে তা নিয়ে একটু চিন্তা করে এবং গভীরভাবে গবেষণা করে তবে সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে যে, এ বিশ্ব অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে সুবিন্যস্ত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। একজন প্রজ্ঞাময়, সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী ইলাহ তা সৃষ্টি করেছেন, তিনি একে উত্তমরূপে সুপরিমিতভাবে বানিয়েছেন।
এ মহাবিশ্বের আকাশ, আকাশের তারকারাজি, গ্রহ নক্ষত্র ও ছায়াপথ আর জমিনে যা কিছু আছে ও যে সব নদ নদী, খাল বিল, পাহাড় পর্বত, পশুপাখি , গাছপালা ইত্যাদিযা কিছু মহান আল্লাহ তায়া’লা অস্তিত্বহীন থেকে সৃষ্টি করেছেন, এসব নিয়ে চিন্তা করলেই আমরা আল্লাহর কুদরত, জ্ঞান, প্রজ্ঞা বুঝতে সক্ষম হই। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
(কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না? আমি পৃথিবীতে ভারী বোঝা রেখে দিয়েছি যাতে তাদেরকে নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে এবং তাতে প্রশস্ত পথ রেখেছি, যাতে তারা পথ প্রাপ্ত হয়। আমি আকাশকে সুরক্ষিত ছাদ করেছি; অথচ তারা আমার আকাশস্থ নিদর্শনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। সবাই আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে)। (আম্বিয়াঃ ৩০-৩৩)
জ্ঞানীলোক যখন আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তখন সে নিশ্চিতভাবে জানতে পারে এ বিশ্বে যা কিছু আছে সব কিছুই আল্লাহর ইবাদত করে। সব সৃষ্টজীব আল্লাহর পবিত্রতা বর্ননা করে ও গুনকীর্তন করেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ (রাজ্যাধিপতি, পবিত্র, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে, যা কিছু আছে নভোমন্ডলে ও যা কিছু আছে ভূমন্ডলে)। (জুম’আঃ ১)
তারা সকলে আল্লাহর মহিমার সামনে সিজদাবনত হয়। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু আছে নভোমন্ডলে, যা কিছু আছে ভুমন্ডলে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি পর্বতরাজি বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং অনেক মানুষ। আবার অনেকের উপর অবধারিত হয়েছে শাস্তি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন, তাকে কেউ সম্মান দিতে পারে না। আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন। (হাজ্বঃ ১৮)
এমনিভাবে সব সৃষ্টজীব মহান আল্লাহ তায়া’লার তাছবিহ পাঠ করে, তাঁর প্রতি বিনীত হয়ে তারই প্রশংসা করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
তুমি কি দেখ না যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা এবং উড়ন্ত পক্ষীকুল তাদের পাখা বিস্তার করতঃ আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই তার যোগ্য এবাদত এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পদ্ধতি জানে। তারা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। (নুরঃ ৪১)
অন্যদিকে মু’মিন ব্যক্তি দেখতে পায় যে, মহাবিশ্ব একটি কাফেলার মত একই দিকে চলমান, আল্লাহ তায়া’লার দিকে চলছে। ফলে সেও এ চলমান পবিত্র কাফেলার সাথে ঐকতানে চলে। এতে তার জীবন আনন্দময় হয় এবং তার বিবেক ও অনুভূতি স্থীর হয়।
এ সুবিশাল মহাবিশ্ব, এর মধ্যকার সকল সৃষ্টি ও বিস্ময়কর বিষয়সমূহ আল্লাহর মহিমা ও কুদরত এবং তাঁর সুনিপুণ সৃষ্টির সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এ সব কিছুই আল্লাহর একত্ববাদ প্রমাণ করে এবং প্রমাণ করে যে, তিনি ছাড়া কোন প্রতিপালক নেই, কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে,তিনি মৃত্তিকা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। এখন তোমরা মানুষ, পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছ। আর এক নিদর্শন এই যে,তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর আর ও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর আরও নিদর্শনঃ রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং তাঁর কৃপা অন্বেষণ। নিশ্চয় এতে মনোযোগী সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর আরও নিদর্শনঃ তিনি তোমাদেরকে দেখান বিদ্যুৎ, ভয় ও ভরসার জন্যে এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তদ্দ্বারা ভূমির মৃত্যুর পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর অন্যতম নিদর্শন এই যে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত আছে। অতঃপর যখন তিনি মৃত্তিকা থেকে উঠার জন্যে তোমাদের ডাক দেবেন, তখন তোমরা উঠে আসবে। নভোমন্ডলে ও ভুমন্ডলে যা কিছু আছে, সব তাঁরই। সবাই তাঁর আজ্ঞাবহ। (সূরা রূমঃ২০-২৬)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ
বল, সকল প্রশংসাই আল্লাহর এবং শান্তি তাঁর মনোনীত বান্দাগণের প্রতি! শ্রেষ্ঠ কে? আল্লাহ না ওরা-তারা যাদেরকে শরীক সাব্যস্ত করে। বল তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে বর্ষণ করেছেন পানি; অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার শক্তিই তোমাদের নেই। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং তারা সত্যবিচ্যুত সম্প্রদায়। বল তো কে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থিত রাখার জন্যে পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না। বল তো কে নিঃসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে পুর্ববর্তীদের স্থলাভিষিক্ত করেন। সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই ধ্যান কর। বল তো কে তোমাদেরকে জলে ও স্থলে অন্ধকারে পথ দেখান এবং যিনি তাঁর অনুগ্রহের পূর্বে সুসংবাদবাহী বাতাস প্রেরণ করেন? অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তারা যাকে শরীক করে, আল্লাহ তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। বল তো কে প্রথমবার সৃষ্টি করেন, অতঃপর তাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন এবং কে তোমাদেরকে আকাশ ও জমিন থেকে রিযিক দান করেন। সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর। (সূরা নামলঃ৫৯-৬৪)
আল্লাহ তায়া’লা বস্তুগত জিনিসের পূজা অর্চনা থেকে মানুষকে মুক্তি দান করেছেন। এ ধরায় যা কিছু আছে, আসমান জমিনে যা কিছু আছে সব কিছুকে মানুষের অধীনস্থ ও আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন। এ সব কিছুই মানুষের জন্য তাঁর দয়া ও মমতা। তিনি জমিন আবাদ ও তাতে মানুষের পূর্ণ খেলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এ সব কিছু করেছেন। অন্যদিকে মানুষ যেন তাঁর পরিপূর্ণ ইবাদাতের উপযুক্ত হয়। এখানে অধীনস্থ বলতে দুটো অর্থ বুঝায়ঃ আল্লাহকে জানা এবং তাঁর দয়া মমতা, সম্মান ও মর্যাদা বুঝার জন্য অধীনস্থ করা। অন্যটি হলোঃ অধীনস্থ বলতে মানুষের মর্যাদা অন্যান্য সব প্রাণী ও জিনিসের উপরে বুঝানো। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
এবং আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন তোমাদের, যা আছে নভোমন্ডলে ও যা আছে ভূমন্ডলে; তাঁর পক্ষ থেকে। (জাসিয়াঃ ১৩)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডল সৃজন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জন্যে ফলের রিযিক উৎপন্ন করেছেন এবং নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন, যাতে তাঁর আদেশে সমুদ্রে চলা ফেরা করে এবং নদ-নদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। এবং তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন সূর্যকে এবং চন্দ্রকে সর্বদা এক নিয়মে এবং রাত্রি ও দিবাকে তোমাদের কাজে লাগিয়েছেন। যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ। (ইবরাহিমঃ ৩২-৩৪)
মানুষের সৃষ্টির কথা বাদ দিলেও আসমান ও জমিনের সৃষ্টি মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। কোন কিছু পুনঃরায় সৃষ্টি করা কি প্রথম বারের সৃষ্টির তুলনায় সহজ নয়ঃ আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
তিনিই প্রথমবার সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন, অতঃপর তিনি সৃষ্টি করবেন। এটা তাঁর জন্যে সহজ। (রুমঃ ২৭)
বরং আসমান জমিনের সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টির তুলনায় অনেক সঠিনতম। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
মানুষের সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না। (গাফিরঃ ৫৭)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
আল্লাহ, যিনি উর্ধ্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে স্তম্ভ ব্যতীত। তোমরা সেগুলো দেখ। অতঃপর তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এবং সূর্য ও চন্দ্রকে কর্মে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শনসমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাত সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। (রা’দঃ ২)