এ মহাবিশ্ব, আসমান ও জমিন মানুষের তুলনায় অনেক বড় হওয়া সত্বেও আল্লাহ তায়া’লা এগুলোকে মানুষের অধীনস্থ ও অনুগত করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এবং আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন তোমাদের, যা আছে নভোমন্ডলে ও যা আছে ভূমন্ডলে; তাঁর পক্ষ থেকে। (জাসিয়াঃ ১৩)
আর এসব কিছু তিনি করেছেন সমস্ত মাখলুকাতের উপরে মানুষের মর্যাদা দিতে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। ( বনী ইস্রাইলঃ ৭০)
আল্লাহ তায়া’লা মানুষ সৃষ্টি করেছেনএবং আমাদেরকে আদম (আঃ) কে সৃষ্টির কাহিনী ও তাকে সম্মানের কথা শুনিয়েছেন। অতঃপর জান্নাত থেকে শয়তানের প্ররোচনায় তাঁকে জমিনে পাঠানো, তার অপরাধের কথা অতঃপর তার তাওবা কবুল করার ঘটনা তিনি বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরপর আকার-অবয়ব, তৈরী করেছি। অতঃপর আমি ফেরেশতাদেরকে বলছি-আদমকে সেজদা কর তখন সবাই সেজদা করেছে, কিন্তু ইবলীস সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। আল্লাহ বললেনঃ আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোকে কিসে সেজদা করতে বারণ করল? সে বললঃ আমি তার চাইতে শ্রেষ্ট। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা। বললেন তুই এখান থেকে যা। এখানে অহংকার করার কোন অধিকার তোর নাই। অতএব তুই বের হয়ে যা। তুই হীনতমদের অন্তর্ভুক্ত । সে বললঃ আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেনঃ তোকে সময় দেয়া হল। সে বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। আল্লাহ বললেনঃ বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাদের যে কেউ তোর পথেচলবে, নিশ্চয় আমি তোদের সবার দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করে দিব। হে আদম তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। অতঃপর সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও তবে এ বৃক্ষের কাছে যেয়োনা তাহলে তোমরা গোনাহগার হয়ে যাবে। অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বললঃ তোমাদের পালনকর্তা তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেননি; তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও-কিংবা হয়ে যাও চিরকাল বসবাসকারী। সে তাদের কাছে কসম খেয়ে বললঃ আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্খী। অতঃপর প্রতারণাপূর্বক তাদেরকে সম্মত করে ফেলল। অনন্তর যখন তারা বৃক্ষ আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে খুলে গেল এবং তারা নিজের উপর বেহেশতের পাতা জড়াতে লাগল। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ডেকে বললেনঃ আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। তারা উভয়ে বললঃ হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব। আল্লাহ বললেনঃ তোমরা নেমে যাও। তোমরা এক অপরের শত্রু। তোমাদের জন্যে পৃথিবীতে বাসস্থান আছে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ফল ভোগ আছে। বললেনঃ তোমরা সেখানেই জীবিত থাকবে, সেখানেই মৃত্যুবরন করবে এবং সেখান থেকেই পুনরুঙ্খিত হবে। (আ’রাফ ১১-২৫)
তিনি মানুষকে উত্তম আকৃতি দিয়ে বানিয়েছেন। অতঃপর তিনি তাতে রূহ ফুঁৎকার করেছেন, ফলে সুন্দর অবয়বে মানুষ সৃষ্টি হলো। সে শোনতে পায়, , দেখতে পায়, নড়াচড়া করতে পারে ও কথা বলতে পারে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়। (মু’মিনুনঃ ১৪)
যা কিছু জানার প্রয়োজন, তার সব কিছুই তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। তার মধ্যে এমন কিছু গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্যাবলী দান করেছেন যা তিনি অন্য কোন প্রাণীকে দান করেননি। সেগুলো হলোঃ বিবেক, জ্ঞান বুদ্ধি, বর্ণনাশক্তি, কথা বলা, সুন্দর ও উত্তম চেহারা সুরত, মর্যাদাবান রূপ আবয়ব, সুঠাম দেহ ও চিন্তা গবেষণা দ্বারা জ্ঞান অর্জন ইত্যাদি। তিনি তাদেরকে উত্তম চরিত্র ও ভাল গুনাবলীর প্রতি পথ প্রদর্শন করেছেন, তাদেরকে তাঁর অনেক সৃষ্টির উপর সম্মানিত করেছেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের সকলের জন্য এ সম্মানের অন্যতম নিদর্শন হলো: আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম মানব আদম (আঃ) কে স্বহস্তে সৃষ্টি করেছেন। ইহা আল্লাহর তরফ থেকে মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস, আমি স্বহস্তে যাকে সৃষ্টি করেছি, তার সম্মুখে সেজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি অহংকার করলে, না তুমি তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন? ( ছোয়াদঃ ৭৫)
আল্লাহ তায়া’লা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সুন্দরতর অবয়বে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে। ( ত্বীনঃ ৭)
তিনি আরো বলেনঃ
তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর সুন্দর করেছেন তোমাদের আকৃতি। তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তন। (তাগাবুনঃ ৩)আল্লাহ তায়া’লা আদম (আঃ) কে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনি বলেনঃ স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললামঃ আদমকে সেজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সেজদায় পড়ে গেল। (বনী ইসরাইলঃ ৬১)
আল্লাহ তায়া’লা মানুষকে বিবেক, চিন্তাভাবনা শক্তি, শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টশক্তি ও অন্যান্য অনুভূতি দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর। (নাহলঃ ৭৮)
আল্লাহ তাআলা মানুষের মাঝে তাঁর রূহ হতে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। এভাবে তাদের মাঝে উন্নত আত্মা বাস্তবায়িত হয়েছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার সম্মুখে সেজদায় নত হয়ে যেয়ো। (ছোয়াদঃ ৭২)
ইহা মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান, এজন্যই মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে হয়। অতএব, যার মধ্যে মহান আল্লাহ পাকের রূহের ফুঁৎকার রয়েছে তাঁর উপরে সীমালঙ্ঘন করা কিভাবে সমীচীন হবে?!!। তিনি ফেরেশতা ও জীন জাতিকে বাদ দিয়ে মানুষকে জমিনের বুকেখলিফা বা প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদিগকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা নিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না। (বাকারাঃ ৩০)
ইহা মানুষের জন্য এক মহা সম্মান যা সেসব ফেরেশতারাও পায়নি যারা আল্লাহ তাআলার আদেশের অবাধ্য হয়না এবং সদা সর্বদা আল্লাহর তাসবিহ তাহলীল ও জিকিরে মশগুল থেকে।
-আল্লাহ তায়া’লা এ মানুষের জন্য আসমান ও জমিনের সব কিছু অধীনস্থ করে দিয়েছেন। এর মধ্যকার চন্দ্র, সুর্য, গ্রহ নক্ষত্র, ছায়াপথ নিহারীকা ইত্যাদি সব কিছু মানুষের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এবং আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন তোমাদের, যা আছে নভোমন্ডলে ও যা আছে ভূমন্ডলে; তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (জাসিয়াঃ ১৩)
মাখলুকাতের যতই মর্যাদা হোক না কেন, সে যত বড়ই হোক না কেন আল্লাহ তায়া’লা মানুষকে তাদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন, নিষেধ করেছেন। ইহা মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা। যেহেতু তিনি তাকে মানুষের দাসত্ব হতে আল্লাহর দাসত্বের দিকে নিয়ে এসেছেন। অতএব আল্লাহর এ ইবাদত ও দাসত্ব অন্যের ইবাদত ও দাসত্ব হতে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা লাভ। এজন্যই তিনি তাঁর ও বান্দার মাঝে মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কোন কোন মানুষ বান্দাহ ও আল্লাহর মাঝে ওসিলা বা মাধ্যম স্থির করেছে এবং সে মাধ্যমকে তারা ইলাহের কিছু গুণে গুণান্বিত করেছে। এজন্যই আল্লাহ পাক মানুষকে সম্মানিত করেছেন এভাবে যে, মানুষ ও আল্লাহর মাঝে কোন মধ্যস্থতা নেই। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তারা তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদিগকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে আল্লাহ ব্যতীত এবং মরিয়মের পুত্রকেও। অথচ তারা আদিষ্ট ছিল একমাত্র মাবুদের এবাদতের জন্য। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তারা তাঁর শরীক সাব্যস্ত করে, তার থেকে তিনি পবিত্র। (তাওবাঃ ৩১)
বস্তুগত উপকরণাদি গ্রহনের সাথে সাথে তাকদির ও আল্লাহর ফয়সালার উপর বিশ্বাসের মাধ্যমে আল্লাহ তায়া’লা মানুষকে শংকা, উদ্বেগ, হতাশা ও বিষণ্নতা থেকে মুক্ত করেছেন। তাকদীরের উপর বিশ্বাসের ফলে ঈমানদারলোক নিরাপদ ও নিরাপত্তায় থাকে, সম্মান ও মর্যাদার অনুভূতি নিয়ে থাকে। আর কোন কিছু হারালে যতক্ষণ সে উপকরণ অবলম্বনে অবহেলা করেনা ততক্ষণ সে দুঃখ-চিন্তাগ্রস্থ বা নিরাশায় পতিত হয়না। কেননা এ সব কিছুই মহান আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ থেকে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। (হাদীদঃ ২২)
মু’মিনের এ বিশ্বাস তাকে আত্মিক সমতা, প্রকৃত স্থিরতা ও অনেক প্রশান্তি দান করে। কেননা কোন বালা মুসিবত তাকে প্রভাবিত বা আতংকিত করতে পারেনা। যেমনিভাবে কোন নেয়ামত ও খুশি তাকে অহংকারী ও ঔদ্ধত্য করেনা।
মানুষের বিবেককে মর্যাদা দিয়েছেন; আল্লাহ তাআলা মানুষের বিবেক ও চিন্তাশক্তিকে অনেক মূল্যবানকরেছেন, তিনি তাকে চিন্তা ও গবেষণা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আসমান ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে বিবেকের মাধ্যমে দলিল পেশ করাকে তিনি ফরয করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তাহলে আপনি বলে দিন, চেয়ে দেখ তো আসমানসমুহে ও যমীনে কি রয়েছে। আর কোন নিদর্শন এবং কোন ভীতিপ্রর্দশনই কোন কাজে আসে না সেসব লোকের জন্য যারা মান্য করে না। (ইউনুসঃ ১০১)
তিনি বিবেককে সম্মান করার জন্য এবং ইহার হেফাযত ও ব্যবহার করতে আদেশ দিয়েছেন। অন্যের অন্ধ অনুসরণ ও গোঁড়ামির মাধ্যমে বিবেককে অসার করতে নিষেধ করেছেন। এজন্যই জ্ঞানসম্পন্ন ব্যাতিত কাউকে শরীয়তের হুকুম দেয়া হয়নি। এমনিভাবে বিবেককে আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার একত্ববাদের উপর প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। বরং কোন বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে তিনি বিবেকের আশ্রয় নিতে বলেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলে দিন, তোমরা সত্যবাদী হলে, প্রমাণ উপস্থিত কর। (বাকারাঃ ১১১)
তিনি বিবেককে কুসংস্কার, ভন্ডামী, ভেলকিবাজি, জ্বীনের দ্বারা তদবীর ও ইহার সদৃশ যা কিছু আছে তা থেকে মুক্তিদান করেছেন। প্রত্যেক মানুষই তার কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করবে, অন্যের কাজের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না।। (ফাতিরঃ ১৮)
মানুষের এ মর্যাদা একটি বড় ব্যাপার, এর দ্বারা তিনি মানবজাতিকে অন্যের বোঝা থেকে মুক্তি দান করেছেন।
বনী আদমকে সম্মান ও মর্যাদাপ্রদান একজাতির উপর সীমিত নয়, বরং তিনি নারী পুরুষ সবাইকেই সমানভাবে মর্যাদা ও সম্মানদান করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। (বাকারাঃ ২২৮)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। (তাওবাঃ ৭১)
আখেরাতের প্রতিদানে নারী পুরুষ থেকে ব্যাতিক্রম হবেনা। সকলে কর্ম অনুযায়ী সমান প্রতিদান পারে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোন পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক। তোমরা পরস্পর এক। (আলে ইমরানঃ ১৯৫)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ যে লোক পুরুষ হোক কিংবা নারী, কোন সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রাপ্য তিল পরিমাণ ও নষ্ট হবে না। (নিসাঃ ১২৪)
আল্লাহ তায়া’লা নারীকে মানুষরূপে সম্মানিত করেছেন, যেহেতু তিনি তাদেরকে পুরুষের ন্যায় সাওয়াব ও শাস্তির ক্ষেত্রে পূর্ণ দায়িত্বশীল ও যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এমনকি মানুষের প্রতি আল্লাহর প্রথম হুকুমও নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একত্রে ছিল। আল্লাহ তায়া’লা প্রথম মানুষ আদম ও তার স্ত্রী হাওয়া (আঃ) সম্পর্কে বলেনঃ এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক, কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথায় তোমরা যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়বে। (বাকারাঃ ৩৫)
এমনিভাবে আল্লাহ তায়া’লা আদম (আঃ) এর জান্নাত থেকে বের হওয়া ও তাঁর পরবর্তী বংশধরদের দুঃখ দুর্দশার জন্য নারীকে দায়ী করেননি, যেমনিভাবে কোন কোন ধর্মে তা করা হয়েছে। বরং আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেন যে, আদম (আঃ) নিজেই সে ব্যাপারে প্রথম দায়ী। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি ইতিপূর্বে আদমকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তার মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি। (ত্বহাঃ ১১৫) অতঃপর তারা উভয়েই এর ফল ভক্ষণ করল, তখন তাদের সামনে তাদের লজ্জাস্থান খুলে গেল এবং তারা জান্নাতের বৃক্ষ-পত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে শুরু করল। আদম তার পালনকর্তার অবাধ্যতা করল, ফলে সে পথ ভ্রষ্ঠ হয়ে গেল। এরপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাকে সুপথে আনয়ন করলেন। (ত্বহাঃ ১২১-১২২)
এমনিভাবে মানুষ হিসেবে নারী পুরুষ সকলেই সমান। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। (হুজরাতঃ ১৩)
নারী পুরুষ উভয়েই নিন্মোক্ত বিষয়গুলোতে সমানভাবে অংশীদারঃ
সামাজিক ও নাগরিক দায়বদ্ধতা বিশেষ করে বস্তুগত অধিকারঃ নারীর আভ্যন্তরীন ব্যক্তিত্বই হলো সম্মানিত ও মূল্যবান। আল্লাহ তাআলা হুকুম-আহকাম ওয়াজিব ও আদায়ের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ সবাইকে সমান করেছেন। নারীকে লেনদেন, বেচাকেনা সব কাজেই পূর্ণ অধিকার দিয়েছেন। এসব সামাজিক ও নাগরিক অধিকার তাদের আবশ্যকীয় প্রাপ্য, তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে কোন শর্ত ও বাঁধা দেয়া যাবেনা। তবে হ্যাঁ যেসব শর্তাবলী পুরুষদের ক্ষেত্রে ও হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। (নিসাঃ ৩২)
উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে তাদের অধিকার রেখেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশী। এ অংশ নির্ধারিত। (নিসাঃ ৭)
ভাল বা খারাপ কাজের প্রতিদান ও শাস্তির ক্ষেত্রে শরিয়তে তাদের অবস্থা পুরুষের মতই করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে তাদের হাত কেটে দাও তাদের কৃতকর্মের সাজা হিসেবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে হুশিয়ারী। আল্লাহ পরাক্রান্ত, জ্ঞানময়। (মায়েদাঃ ৩৮)
এমনিভাবে পরকালের প্রতিদানেও উভয়ের সমান। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমাণদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত। (নাহলঃ ৯৭)
তারা উভয়ে উভয়ের বন্ধু ও সাহায্যকারী। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা’আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী। (তাওবাঃ ৭২)
নারীর সাথে কোমল আচরণ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যুদ্ধে নারীকে হত্যা করা হারাম করেছেন। হায়েজগ্রস্থ নারীদের সাথে একত্রে খাওয়া- দাওয়া করার এবং সহবাস ছাড়া মেলামেশা করতে আদেশ দিয়েছেন। ইহুদীরা এসব করতে নিষেধ করত, তারা নারীকে হায়েজ অবস্থায় দূরে সরিয়ে রাখত, পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে খাওয়া- দাওয়া করত না।
নারীরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম কর্তৃক সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছেন। কারণ তিনি বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম, আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের নিকট সর্বোত্তম ব্যক্তি”। (তিরমিজি, ইমাম তিরমিজি বলেনঃ হাদিসটি হাসান ও সহীহ)।
রাসুলের (সাঃ) এর যুগে কোন এক নারীকে প্রহর করা হলে তিনি খুবই রাগান্বিত হন। তিনি বললেনঃ “তোমাদের কেহ কেহ তার স্ত্রীকে দাস-দাসীর মত প্রহার করে অতঃপর দিনের শেষে কিভাবে তার সাথে মিলিত হবে!” (বুখারী)
যখন একদল মহিলা রাসুলের (সাঃ) নিকট তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে এসেছিলেন, তখন রাসুল (সাঃ) বললেনঃ “অনেকের স্ত্রী তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে মুহাম্মদের পরিবারে এসেছে, সে সব স্বামীরা উত্তম লোকদের অন্তর্ভূক্ত নয়”। (আবু দাউদ)
ইসলাম নারীকে যে পরিমান মর্যাদা দিয়েছে পুরুষকে ততখানি দেয়নি। আল্লাহ তায়া’লা মায়ের সাথে পিতার চেয়ে বেশি সদ্ব্যবহার করতে আদেশ দিয়েছেন। এক লোক রাসুলের (সাঃ) নিকট এসে জিজ্ঞেস করলঃ হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার বেশী হকদার? তিনি বললেনঃ তোমার মা। লোকটি বললঃ তারপর কে? নবী করিম (সাঃ) বললেনঃ তোমার মা। সে বললঃ তারপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা। সে বললঃ তারপর কে? তিনি বললেনঃ তারপর তোমার বাবা। (বুখারী ও মুসলিম)।
পুত্র সন্তানের চেয়ে কন্যা সন্তানের পালল পালনের জন্য অধিক সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ “যাদেরকে কন্যা সন্তান দান করা হয়েছে, অতঃপর তাদেরকে সুন্দরভাবে লালন পালন করেছে, সে সব কন্যা সন্তান তাদেরকে জাহান্নাম থেকে আড়াল করে রাখবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
তিনি (সাঃ) আরো বলেছেনঃ “হে আল্লাহ আমি দুই দুর্বলের জটিলতা নিরসণের ব্যাপারে আপনার নিকট প্রার্থণা করছি, তারা হলঃ ইয়াতীম ও নারী” (হাদিসটি হাসান, ইমাম নাসাঈ উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন)।