সর্বদা প্রত্যেক আক্বীদায় বিশ্বাসীরা মনে করেন যে, সে যে বিশ্বাস করে সেটাই গ্রহণযোগ্য ও সত্য, অন্যেরটা মিথ্যা। এ ক্ষেত্রে নিজেদেরটা নির্ভূল প্রমাণ করতে প্রত্যেক আক্বীদার লোকেরা নানারকম যুক্তি দিয়ে থাকে। মানবরচিত ভ্রান্ত আক্বীদা বা ভ্রষ্ট রূপান্তরিত আক্বীদার লোকেরা নিজেদের আক্বীদাকে নির্ভূল প্রমাণ করতে বলে থাকেন, আমরা আমাদের বাপ দাদাদেরকে এ আক্বীদার উপর পেয়েছি, তাই আমরা তাদের অনুসরণ করি। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এমনিভাবে আপনার পূর্বে আমি যখন কোন জনপদে কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের বিত্তশালীরা বলেছে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক পথের পথিক এবং আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে চলছি। সে বলত, তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে বিষয়ের উপর পেয়েছ, আমি যদি তদপেক্ষা উত্তম বিষয় নিয়ে তোমাদের কাছে এসে থাকি, তবুও কি তোমরা তাই বলবে? তারা বলত তোমরা যে বিষয়সহ প্রেরিত হয়েছ, তা আমরা মানব না। (যুখরুফঃ ২৩-২৪)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর যখন তাদেরকে কেউ বলে যে, সে হুকুমেরই আনুগত্য কর যা আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেছেন, তখন তারা বলে কখনো না, আমরা তো সে বিষয়েরই অনুসরণ করব। যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে দেখেছি। যদি ও তাদের বাপ দাদারা কিছুই জানতো না, জানতো না সরল পথও। বস্তুতঃ এহেন কাফেরদের উদাহরণ এমন, যেন কেউ এমন কোন জীবকে আহবান করছে যা কোন কিছুই শোনে না, হাঁক-ডাক আর চিৎকার ছাড়া বধির মুক, এবং অন্ধ। সুতরাং তারা কিছুই বোঝে না। (বাকারাঃ ১৭০-১৭১)
তারা তাদের এ অবস্থানকে দৃঢ় করতে জ্ঞানহীনভাবে কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই অন্ধ অনুসরণের উপর নির্ভর করে। অথবা মিথ্যা, ভ্রান্ত, পরস্পর বিরোধপূর্ণ যার কোন সনদ ও দলিল নাই এমন সব সংবাদ ও রেওয়াতের উপর নির্ভর করে। ফলে এসব ধর্ম, মতবাদ ও বিশ্বাসের কোন দলিল প্রমাণ গ্রহণযোগ্য নয়।
সত্য যেহেতু একটিই, একাধিক হতে পারেনা, তাই সব আক্বীদার লোকেরাই সঠিক তা বলাও অসম্ভব। কেননা এতে সত্য পরস্পর বিরোধপূর্ণ হয়ে যাবে। আর ইহা সুস্থ বিবেক অস্বীকার করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত। (নিসাঃ ৮২)
তাহলে সত্য ধর্ম কোনটি? এর বৈশিষ্ট্য ও নিয়মাবলী কি যাতে আমরা হুকুম দিতে পারি এ আক্বীদার বিশ্বাসীরা সত্য ও সঠিক আর ইহা ছাড়া অন্যরা ভ্রান্ত ও বাতিল -যাদের মধ্যে উক্ত বৈশিষ্ট্য ও নিয়মাবলী পাওয়া যাবেনা-।
সত্য ধর্মের বৈশিষ্ট্য ও নিয়মাবলী হলোঃ
ধর্মটির মূল উৎস হবে খোদা প্রদত্ত। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাকের তরফ থেকে আসবে। আল্লাহ তায়া’লা ফেরেশতাদের মাধ্যমে নবী রাসুলের দ্বারা বান্দাহদের কাছে তার বাণী অবতীর্ণ করবেন। কেননা সত্য ধর্ম হলো এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়া’লার প্রেরিত ধর্ম। তিনি তাদের কাছে যে ধর্ম প্রেরণ করেছেন কিয়ামতের দিবসে সে ব্যাপারে সৃষ্টিকূলের কাছ থেকে হিসেব নিবেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আপনার প্রতি ওহী পাঠিয়েছি, যেমন করে ওহী পাঠিয়েছিলাম নূহের প্রতি এবং সে সমস্ত নবী-রসূলের প্রতি যাঁরা তাঁর পরে প্রেরিত হয়েছেন। আর ওহী পাঠিয়েছি,ইসমাঈল,ইব্রাহীম,ইসহাক, ইয়াকুব, ও তাঁর সন্তাবর্গের প্রতি এবং ঈসা, আইয়ুব,ইউনূস, হারুন ও সুলায়মানের প্রতি। আর আমি দাউদকে দান করেছি যবুর গ্রন্থ। এছাড়া এমন রসূল পাঠিয়েছি যাদের ইতিবৃত্ত আমি আপনাকে শুনিয়েছি ইতিপূর্বে এবং এমন রসূল পাঠিয়েছি যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শোনাইনি। আর আল্লাহ মূসার সাথে কথোপকথন করেছেন সরাসরি। সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রসূলগণের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশীল,প্রাজ্ঞ। (নিসাঃ ১৬৩-১৬৫)
এর উপর ভিত্তি করে বলতে পারি, যে সব ধর্মকে আল্লাহর দিকে নিসবত বা সম্পর্কিত না করে কোন ব্যক্তির দিকে সম্পর্কিত করা হয় তা দ্ব্যর্থহীনভাবে বাতিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর যেসব ধর্ম মানুষের দ্বারা উন্নতি লাভ করে, মানুষ এতে কোন কিছু সংযোগ করে, ইহাকে সজ্জিত করে সে ধর্মও দ্বিধাহীনভাবে বাতিল। কেননা যে ব্যক্তি ধর্মটি উন্নত ও পরিবর্তন করল সে মানুষের সার্বিক কল্যাণ সম্পর্কে জ্ঞাত সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর চেয়ে বেশী জ্ঞাত নন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি করে জানবেন না? তিনি সূক্ষ্মজ্ঞানী, সম্যক জ্ঞাত। (মুলকঃ ১৪)
তা নাহলে উন্নয়নকারী বা শরিয়ত প্রবর্তকই রব ও ইলাহ হতেন, যিনি সৃষ্টির ভাল মন্দ সম্পর্কে জানবেন। আল্লাহ তায়া’লা এমন শরীক হতে অনেক উর্ধ্বে। তিনি বলেনঃ তারা কি আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন তালাশ করছে? আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাঁরই অনুগত হবে এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাবে। (আলে ইমরানঃ ৮৩)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ অতএব,তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। (নিসাঃ ৬৫)
ধর্মটি এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করবে। শিরককে হারাম করবে। তাওহীদের প্রতি দাওয়াত সব নবী রাসুলেরই মূল দাওয়াত ছিল। শিরক ও পৌত্তলিকতা সুস্থ স্বভাব ও জ্ঞানবান বিবেক অস্বীকার করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই এবাদত কর। (আম্বিয়াঃ ২৫)
প্রত্যেক নবীই তাদের জাতিকে বলেছেনঃ সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। আমি তোমাদের জন্যে একটি মহাদিবসের শাস্তির আশঙ্কা করি। (আ’রাফঃ ৫৯)
অতএব, যে ধর্মই শিরককে মেনে নেয় বা আল্লাহর সাথে কোন নবী রাসুল, ফেরেশতা, অলী, মানুষ বা পাথর ইত্যাদির অংশীদার করে সে সব ধর্ম বাতিল। কেননা ইবাদত শুধুমাত্র এক আল্লাহর, যার কোন শরিক নেই। পৌত্তলিকতা ও শিরক স্পষ্ট ভ্রান্ততা, ভ্রষ্টতা। যে কোন ধর্মই এমনকি যদিও তা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে যদি এতে শিরক প্রবেশ করে তাহলে তা বাতিল। আল্লাহ তায়া’লা এ ব্যাপারে উদাহরণ পেশ করে বলেনঃ হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না, প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন। তারা আল্লাহর যথাযোগ্য মর্যাদা বোঝেনি। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিধর,মহাপরাক্রমশীল। (হাজ্বঃ ৭৩-৭৪)
ইহা সুস্থ স্বভাবের সাথে একমত হতে হবে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। (রূমঃ ৩০)
ফিতরত হলো যে স্বভাবের উপর মহান আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। ইহা তার সৃষ্টির অংশ হয়ে যায়। যেহেতু দ্বীন মানুষের স্বভাবের উপযোগী হবেনা এটা হতে পারেনা। তা নাহলে সৃষ্টিকর্তা উক্ত দ্বীনের প্রবর্তক নয়। ইহা অসম্ভব ব্যাপার ও শিরক।
সুস্থ আকল বা বিবেকের সাথে একমত হতে হবে। কেননা সত্য ধর্ম আল্লাহর শরিয়ত, আর সুস্থ বিবেকও আল্লাহর সৃষ্টি, তাই আল্লাহর শরিয়ত ও আল্লাহর সৃষ্টি পরস্পর বিরোধপূর্ণ হবে এটা অসম্ভব। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তারা কি এই উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণ করেনি, যাতে তারা সমঝদার হৃদয় ও শ্রবণ শক্তি সম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে? বস্তুতঃ চক্ষু তো অন্ধ হয় না, কিন্তু বক্ষ স্থিত অন্তরই অন্ধ হয়। (হাজ্বঃ ৪৬)
তিনি আরো বলেনঃ নিশ্চয় নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে মুমিনদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। আর তোমাদের সৃষ্টিতে এবং চারদিকে ছড়িয়ে রাখা জীব জন্তুর সৃজনের মধ্যেও নিদর্শনাবলী রয়েছে বিশ্বাসীদের জন্য। দিবারাত্রির পরিবর্তনে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে রিযিক (বৃষ্টি) বর্ষণ করেন অতঃপর পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত করেন, তাতে এবং বায়ুর পরিবর্তনে বুদ্ধিমানদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। এগুলো আল্লাহর আয়াত,যা আমি আপনার কাছে আবৃত্তি করি যথাযথরূপে। অতএব, আল্লাহ ও তাঁর আয়াতের পর তারা কোন কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবে। (জাসিয়াঃ ৩-৬)
সত্য ধর্ম কাল্পনিকতা, কুসংস্কার বা পরস্পর অসঙ্গতি দ্বারা পূর্ণ থাকতে পারেনা। ইহা সুস্থ বিবেকের পরিপন্থী। এক সময় একটি আদেশ দিবেন আবার অন্য সময় অন্য আরেকটি আদেশ দিবেন, একটি জিনিসকে হারাম করবেন, অতঃপর তা একদলের জন্য জন্য তা জায়েজ করবেন, আবার অন্যদের জন্য হারাম করবেন, অথবা সদৃশ বিষয়ে পার্থক্য করবেন, বা বিরোধপূর্ণ দুটি বিষয় একত্রিত করবেন সত্য ধর্ম কখনোই এরূপ হতে পারেনা।
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এরা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও পক্ষ থেকে হত,তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত। (নিসাঃ ৮২)
বরং সুস্পষ্ট দলিল প্রমানের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলে দিন,তোমরা সত্যবাদী হলে, প্রমাণ উপস্থিত কর। (বাকারাঃ ১১১)