মানুষ ধর্ম ছাড়া কোনভাবেই বাস করতে পারেনা।
মানুষ যেভাবে স্বভাবগতভাবেই সামাজিক, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী বসবাস করতে পারেনা, সেভাবে সে স্বভাবগতভাবেই ধার্মিক, সে ধর্ম ছাড়া স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেনা। ধার্মিকতা মানুষের স্বভাবজাত ব্যাপার।
কষ্ট ও বিপদে আপদে পড়লে মানুষ আল্লাহ তায়া’লার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে এটাই তার ধার্মিকতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তারা যখন জলযানে আরোহণ করে তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে। (আনকাবুতঃ ৬৫)
যেমনিভাবে কোন যন্ত্রের তৈরিকারক ঐ যন্ত্র ও উহার প্রয়োজন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জ্ঞাত, তেমনিভাবে মহান স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টি ও তাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানবেন না? তিনি তো সূক্ষ্মজ্ঞানী, সম্যক জ্ঞাত। (মুলকঃ ১৪(
কেননা স্রষ্টা দয়ালু, ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। তিনি মানুষের জন্য এমন শরিয়তের প্রবর্তন করেছেন যা তাদের অন্তরকে জাগ্রত করে ও তাদের জীবনকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ হে ঈমানদারগণ,আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য কর,যখন তোমাদেরকে সে কাজের প্রতি আহবান করা হয়,যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। (আনফালঃ ২৪)
এজন্যই যারা নিজেদের স্বভাবজাতের বিরোধিতা করে ও আল্লাহকে অস্বীকার করে তারা মূলতঃ নিজেরাই নিজেদের মিথ্যাচার ও অস্বীকৃতি সম্পর্কে জানে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তারা অন্যায় ও অহংকার করে নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যান করল,যদিও তাদের অন্তর এগুলো সত্য বলে পরিণাম কেমন হয়েছিল? (নামলঃ ১৪)
আর এ সব কিছু স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যখন সে বিপদ আপদ ও কষ্টে পতিত হয়। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলুন,বলতো দেখি, যদি তোমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি পতিত হয় কিংবা তোমাদের কাছে কিয়ামত এসে যায়, তবে তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ডাকবে যদি তোমরা সত্যবাদী হও। বরং তোমরা তো তাঁকেই ডাকবে। অতঃপর যে বিপদের জন্যে তাঁকে ডাকবে, তিনি ইচ্ছা করলে তা দুরও করে দেন। যাদেরকে অংশীদার করছ, তখন তাদেরকে ভুলে যাবে। (আন’আমঃ ৪০-৪১(
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ যখন মানুষকে দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে একাগ্রচিত্তে তার পালনকর্তাকে ডাকে, অতঃপর তিনি যখন তাকে নেয়ামত দান করেন, তখন সে কষ্টের কথা বিস্মৃত হয়ে যায়, যার জন্যে পূর্বে ডেকেছিল এবং আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করে; যাতে করে অপরকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে। বলুন, তুমি তোমার কুফর সহকারে কিছুকাল জীবনোপভোগ করে নাও। নিশ্চয় তুমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত। (যুমারঃ৮ )
সমস্ত মানবই স্বভাবগতভাবেই সে আল্লাহর ইবাদত স্বীকার করে যার হাতে রয়েছে কল্যাণ, অকল্যাণ, যিনি যা ইচ্ছা তাই করেন, যা চান তাই করেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নেই। পক্ষান্তরে যদি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। (আন’আমঃ ১৭)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আল্লাহ মানুষের জন্য অনুগ্রহের মধ্য থেকে যা খুলে দেন, তা ফেরাবার কেউ নেই এবং তিনি যা বারণ করেন,তা কেউ প্রেরণ করতে পারে না তিনি ব্যতিত। (ফাতিরঃ ২)
মানুষের দু’টি শক্তি রয়েছে। জ্ঞান শক্তি, আরেকটি হলো ইচ্ছাশক্তি। এ দুটোতে তার চেষ্টানুযায়ী সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পৌঁছায় এবং এভাবেই মানুষ সৌভাগ্য লাভ করে। প্রথমটি অর্থাৎ জ্ঞানের শক্তি হলোঃ আল্লাহ সম্পর্কে তার জ্ঞান, তার সুন্দর নাম ও গুণাবলী, তার আদেশ, নিষেধ, আচরণ, নৈতিকতা,কিভাবে তার নিকটবর্তীজনের পথে চলা যায়,তার পথে চলা ব্যক্তিদের পথে চলে কিভাবে মর্যাদা সুউচ্চ করা যায় তাঁর জ্ঞান এবং মানবাত্মার গভীরের প্রয়োজনীয় জ্ঞান, ইহার রোগব্যাধি,প্রতিরোধ, ক্ষতিকর জিনিস ও যে সব কিছু তার মাঝে ও তার প্রতিপালকের মাঝে বাঁধা সৃষ্টি করে ইত্যাদির জ্ঞান অর্জন করা।
এছাড়াও খোদাভীরুদের আখলাক ধারণ করে আত্মাকে পরিশুদ্ধ ও উন্নত করা, এতে তার আত্মা সুউচ্চ ও মহান আত্মায় পরিণত হয়। অর্থহীন পার্থিব সব কিছু ও ভোগ বিলাস থেকে দূরে থাকা। এসব কিছুর উপর ভিত্তি করে আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর স্তর এবংতাঁর স্থান ও মর্যাদা নির্ধারন হয়, বরং এতে তার দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-শান্তি অর্জিত হয়।
বরং এ সব জ্ঞানের শক্তি ইচ্ছাশক্তির জন্য পাথেয় ও অবলম্বন, যেহেতু এতে আছে হেদায়েত এবং দৃঢ়তা ও সঠিকপথ । আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ হে ঈমানদারগণ,আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য কর,যখন তোমাদের সে কাজের প্রতি আহবান করা হয়, যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। (আনফালঃ ২৪)
নাস্তিকেরা আত্মিক পরিতৃপ্তি ছাড়াও দৈহিক শান্তির ব্যাপারেও তাদের দৈন্যতা স্বীকার করে।তারা যতই ভ্রান্ত কথা সাজিয়ে গুছিয়ে পেশ করুকনা কেন কিন্ত মানুষের প্রকৃত শান্তির জন্য কোন কিছুই পেশ করতে পারেনি।
বিপদে আপদে, বালামুসিবতে মানুষ কার নিকট আশ্রয় পার্থনা করে?! সে শক্ত ভিত্তির কাছে আশ্রয় চায়,আল্লাহ তায়া’লার নিকট আশ্রয় চায়। যেহেতু তার কাছেই রয়েছে সর্বশক্তি, আশা আকাঙ্ক্ষা, ধৈর্য্য, উত্তম ভরসা ও সব কাজ তার নিকটই সোপর্দ করা হয়। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়। (রা’দঃ ২৮)
যখন সে জুলুমের আগুনে দগ্ধ হয় এবং তার তিক্ততা অনুভব করে তখন সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এ মহাবিশ্বের একজন প্রতিপালক আছেন, তিনি বিলম্বে হলেও মাজলুমকে সাহায্য করেন, আখেরাতের দিবসে প্রত্যেক মানুষ তার কৃতকর্মের ফলাফল পাবে, সৎ কর্মশীলকে পুরুস্কার দেয়া হবে আর অসৎ কর্মকারীকে শাস্তি দেয়া হবে। তখন আত্মবিশ্বাস ও আল্লাহর উপর ভরসা পেয়ে তার অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ যে লোক আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত, সে কি ঐ লোকের সমান হতে পারে, যে আল্লাহর রোষ অর্জন করেছে? বস্তুতঃ তার ঠিকানা হল দোযখ। আর তা কতইনা নিকৃষ্ট অবস্থান! (আলে ইমরানঃ ১৬২)
পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিচিতি পেলনা, তার উপর ঈমান আনলনা, সে সব শক্তি হারিয়ে ফেলে, আরাম, আত্মবিশ্বাস ও সুখ-শান্তি সব কিছুই হারিয়ে ফেলে। তখন সে উদ্বেগ ও দুঃখের ভিতর ঘুরতে থাকে। আত্মিক কোন স্থিরতা বা অভ্যন্তরীণ কোন শান্তি থাকেনা। তার সব লক্ষ্য উদ্দেশ্য হয়ে যায় ভোগ বিলাস, ক্ষুধা নিরারণ ও সম্পদ অর্জন। সে তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য জানেনা, জানেনা তার জীবনের লক্ষ্য, বরং দিশেহারা জীবন যাপন করে, যৌনলালসা পূরণের মাধ্যমে শান্তি তালাশ করে। এমনকি তারা জন্তু জানোয়ারের মতই আচরণ করে বরং তাদের চেয়েও অধম জীবন যাপন করে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনি কি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বোঝে ? তারা তো চতুস্পদ জন্তুর মত; বরং আরও পথভ্রান্ত। (ফুরকানঃ ৪৪)
মানসিক বিপর্যয় ও অন্তরের অস্থিরতায় নিপতিত হয়ে সে মুসীবতগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। (ত্বহাঃ ১২৪)
অতএব যারা তাদের রবের পরিচয় পেয়েছে, তার মহানতা জানতে পেরেছে, স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য বুঝতে সক্ষম হয়েছে, সর্বদা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায় থাকে, তাঁর শরিয়তের অনুসরণ করে, তাঁর আদেশ নিষেধ মান্য করে, আর জানে যে, তাঁর ছোট বড়, সুক্ষ্ম অসুক্ষ্ম সব কাজেই সব সময়ই তার রবের মুখাপেক্ষী, আর যারা এসব জানেনা এ দু’য়ের মাঝে অনেক বড় পার্থক্য । আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ হে মানুষ,তোমরা আল্লাহর গলগ্রহ। আর আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত। (ফাতিরঃ ১৫)