সোয়া দুই ঘন্টার সফরের পর দু’বন্ধু প্যারিসে এসে পৌঁছল। রাশেদ ইতিপূর্বে এখানে আসেনি, দু’বন্ধু স্টেশন থেকে বের হল। মাইকেলকে দেখে মনে হল, সে প্যারিস শহর ভাল করে চিনে এবং এ শহরের সাথে তার গভীর সম্পর্ক আছে।
মাইকেলঃ রাশেদ! এ হলো প্যারিস শহর, আলোর রাজধানী, এখান থেকে বিশ্ব স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব ও সমতার প্রতীক জানতে পেরেছে, বিশ্বের মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা এখান থেকে চালু হয়েছে।
রাশেদঃ দেখ!! মাইকেল দেখ! এ মহিলাকে পুলিশ আটকিয়েছে, তাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে না যে, সে কোন অপরাধ বা আইন ভঙ্গ করেছে!
মাইকেলঃ ওহ, সে নেকাব পরিহিতা। দু’দিন ধরে ফ্রান্সের পাবলিক জায়গায় নেকাব পরে চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সম্ভবত এ পুলিশআইন ভঙ্গ করার কারনে জরিমানা করার জন্য তার গতিরোধ করেছে, তাকে আটক ও করতে পারে।
রাশেদঃ পাবলিক জায়গা!? অর্থাৎ গৃহে বোরকা পড়তে আইনী কোন অসুবিধে নেই.... মাশাল্লাহ! নারী ও মুসলমানদের জন্য চুড়ান্ত স্বাধীনতা! আমার মনে পড়েছে এ আইনের কথা। আরো মনে পড়েছে যে, এ আইন শুধু ফ্রান্সেই নয় বেলজিয়ামেও কিছুটা আছে, উত্তর ইতালিতেও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নেদারল্যান্ড এবং স্পেন সহ অন্যান্য দেশেও এ আইন চালু করার সর্বাত্বোক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় পুলিশের ক্ষমতা রয়েছে যে, নেকাব পরিহিতাকে চেহারা খুলে তার পরিচয় জানতে চাওয়া।
মাইকেলঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ সব নিষেধাজ্ঞা নারীদের ইচ্ছা-স্বাধীনতামত পোশাক পরিধানে বাঁধা সৃষ্টি করে। এসব আইন ফ্রান্সে স্বাধীনতার জন্য একটি বিপত্তি। প্রকৃতপক্ষে এটা এমন একটা দেশে ব্যাক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ যেখানে শতশত আইন আছে যা অন্যের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে আহবান করে।
রাশেদঃ ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিতে রাষ্ট্রে ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে নিষিদ্ধ নয়। তারপর এ সব নিষেধাজ্ঞা কেন শুধু মুসলমানের জন্য হবে? যারা বুকে ক্রুশ বা পাদ্রীর পোশাক পরে তাদের সাথে কি তারা এমন করে?! তাদের দৃষ্টিতে গোলামীর এ অর্থ বড়ই আশ্চর্যের ব্যপার । তাহলে নারীদেরকে উলঙ্গ করে পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য ছেড়ে দেয়ার নাম দাসত্ব থেকে মুক্তি !! আর নারীরা স্বেচ্ছায় তাদের পূর্ন শরীর আবৃত করে চলার নাম দাসত্ব!! হ্যাঁ বন্ধু বোরকা পড়া আসলেই দাসত্ব, তবে তা প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বের পালনকর্তা আল্লাহ তায়া’লার দাসত্ব।
এখন আমি ফান্সের বিপ্লবের শ্লোগানে স্বাধীনতার অর্থ কি তা বুঝেছি... আল্লাহ ও তার গোলামীর সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার স্বাধীনতা। সৃষ্টজীবের থেকে স্বাধীনতা নয়। এ সব স্বাধীনতা ধর্মনিরেপেক্ষ রাষ্ট্রের সরকার চালু করেছে, যেখানে আল্লাহর স্থানকে অপমানিত করে সেখানে যথেচ্ছা , যেভাবে খুশি সেভাবে চলার স্বাধীনতাকে বাস্তবায়ন করেছে। তারা স্বাধীনতার সংজ্ঞায় বলেঃ “অপরের স্বাধীনতা যেখানে শুরু সেখানে তোমার স্বাধীনতা শেষ”। তাহলে তারা কি নারীর শরীর অন্যরা দেখাকে স্বাধীনতা মনে করে? আর এ জন্য কি মুসলিম নারীর স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে দিবে?! আসলে ব্যাপারটা পর্দার বিষয় নয়, ইউরোপের মানুষ ইসলামের জয়গানে ভীত হয়ে পড়ছে।
মাইকেলঃ রাশেদ তুমি বিষয়টাকে এত বড় করে দেখোনা। কেননা ইউরোপে অনেক মুসলমান বসবাস করে, তারা অন্যদের মত নিজেদের অধিকার পেয়ে থাকে, এমনিভাবে তাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা ও কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ যা তাদের দেশেও নাই।
রাশেদঃ আমি বিষয়টিকে বড় করছিনা, তবে এ ব্যাপারে অনেক প্রমাণ আছে যে, তাদের মূল ভয় হচ্ছে ইসলাম।
মাইকেলঃ যেমন কি?
রাশেদঃ সুইজারল্যান্ডের মত মানবাধিকার রক্ষাকারী,ধর্ম নিরপেক্ষ এবং জেনেভা কনভেনশন চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশে মসজিদের মিনার তৈরি নষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মিনার তৈরিতে সমাজের কি ক্ষতি হত?! যে দেশে মুসলমানের সংখ্যা ৪% এর বেশী হবেনা, যেখানে মাত্র চারটি মিনার রয়েছে। একথা স্পষ্ট যে, তাদের এ সব নিষিদ্ধের মূলে রয়েছে ভয় ও ইসলামের প্রতি শত্রুতা পোষণমাত্র।
মাইকেলঃ যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এ সব নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করিনা, তবে আমি বুঝতেছি তারা মনে করেন যে, এ সব মিনার তাদের রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের সাথে বিরোধপূর্ণ, এগুলোকে তাদের দেশের পরিচয়ের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন।
রাশেদঃ ঠিক আছে যদি তারা এ সব নিষেধাজ্ঞা অন্যান্য সব ধর্মের চিহ্ন যেমনঃ খৃষ্টানদের গীর্যা, ইহুদীদের উপাসনালয় ইত্যাদির ব্যাপারে করত তবে বুঝতাম তাদের ধর্মনিরেপেক্ষ রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতায় তারা এগুলো করে, তাহলে তারা যে সমঅধিকারের বুলি আওড়ায় তার বাস্তবতা বুঝতাম। ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়, বরং তাদের সীমালঙ্ঘন ইসলামের মূলপ্রতীক পর্যন্ত পৌঁছেছে, এমনকি ইসলামের নবীর উপরও আক্রমন করেছে। যেমন আমরা দেখেছি, ডেনমার্কে আমাদের রাসুল সাঃ কে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্বক কার্টুনের ঘটনা ঘটেছে আর অন্যান্য কিছু দেশ তাদের এ সীমালঙ্ঘনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
মাইকেলঃ হে বন্ধু! এগুলো বাক-স্বাধীনতা। আমাদের দেশে বাক-স্বাধীনতার কাছে কোন পবিত্র বা নিষিদ্ধ জিনিস নাই। অনেকবার হযরত ঈসা আঃ ও অন্যান্য ধর্মপ্রতীকের ব্যাপারেও এ ধরনের সমালোচনা ও উপহাস হয়েছে।
রাশেদঃ বরং তোমাদের কাছেও অতি পবিত্র কিছু জিনিস আছে যা তোমরা বাক-স্বাধীনতা এমনকি স্বাধীন বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারাও একে স্পর্শ করোনা। ডেনমার্কের ম্যাগাজিনের রাসুলের সাঃ কার্টুন প্রকাশের পর ইউরোপের অনেক দেশে তা সংক্রমিত হয় এবং পশ্চিমা কিছু সরকার এর পক্ষ নেয়, যদিও তা দেড় শত কোটি মুসলমানের মহান ধর্মীয় প্রতীকে আঘাত হানে। পাশ্চাত্যেরবাক-স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে তারা এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে অস্বীকার করে
হলোকস্ট হত্যাকান্ডের ব্যাপারেইহুদীদের জালিয়াতি সম্পর্কে কার্টুন প্রকাশের জন্য ডাচ আপিল বিভাগ ডাচ মুসলিম গোষ্ঠীকে ২৫০০ ইউরো জরিমানা করেছিল। আদালত এ রায়ের কারণ দর্শিয়ে বলে যে, মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় আদালত বাক-স্বাধীনতার গুরুত্ব দিবে, তবে কেউ হলোকস্ট হত্যাকান্ড সম্পর্কে কোন নেতিবাচক কিছু বলতে পারবেনা, এটাকে আলাদাভাবে দেখা হবে।
ফ্রান্সের এক আদালত ১৯৯৮ সালে সে দেশের গবেষক জারুদীর বিরুদ্ধে হলোকস্ট হত্যাকান্ডের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টির অভিযোগে চার্জ গঠন করে, কারন সে শুধুমাত্র ইউরোপে নাৎসি বাহিনীর হাতে নিহত ইহুদিদের প্রচলিত সংখ্যার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল।
অস্ট্রীয় আদালত ইহুদীদের হলোকস্ট হত্যাকান্ডের বিস্তারিত তথ্য অস্বীকার করার কারনে ২০০৬ সালে বৃটিশ ঐতিহাসিক ডেভিড ইরভিং কে তিন বছরের কারাদন্ড দেয়।
২০০৯ সালে জার্মানের উচ্চ আদালত বৃটিশ ক্যাথলিক রিচার্ড উইলিয়ামসনকে দশ হাজার ইউরো জরিমানা করেন, কেননা সে ঘোষনা করেছিল যে, নাৎসী হত্যা ক্যাম্পে দুই থেকে তিন লাখ ইহুদি হত্যা করা হয়েছিল।
এরকমভাবে তাদের মত আরো অনেকে এ পবিত্র বিষয়ে বাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীন গবেষণার আশ্রয় খুঁজে পায়নি।
মাইকেলঃ অবশ্যই, ইতিহাসের লম্বা পরিক্রমায় খৃষ্টান ও মুসলমানের মাঝে বিদ্যমান বিরোধ, এ ছাড়াও মুসলমানের সর্বশেষ জঙ্গি তৎপরতা ইত্যাদি অনেকের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে ভীতির সঞ্চার করেছে, অথচ এ সব তৎপরতা হিন্দু বা বৌদ্ধ বা অন্যদের মাঝে ততটা দেখিনা। তুমি কি অস্বীকার করতে পারবা যে, মুসলমানের কিছু কিছু কাজ কর্ম দেখে মানুষ ইসলামকে ভয় পায়?
রাশেদঃ হ্যাঁ এবার আমরা বাস্তবতার কিছুটা কাছাকাছি এসে গেছি। আমি মুসলমান কিছু লোক, গোষ্ঠী বা দলের কিছু আচার আচারনের কথা অস্বীকার করবনা। এ সবের সুযোগ নিয়ে কোন কোন শত্রুপক্ষ মানুষের মাঝে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও ভীতি উস্কে দিচ্ছে....কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব কতোটুকু তা দেখতে হবে। আমরা একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে আক্রমন করার অনেক কারন রয়েছে, আর এসব ঘটনাকে ব্যাবহার করে বিভিন্ন বিভিন্ন ইসলামবিরোধী দল তাদের লক্ষ্য হাসিলে তৎপর হয়।তাছাড়া আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে খেয়াল করলেই দেখব যে, কোন ধর্মীয় দল বা উপদল নেই যাদের মাঝে এসব শত্রুতাপূর্ণ ঘটনা নেই। কিন্তু এ সব ঘটনাকে সকলের উপর সমানভাবে ব্যবহার বা কারো কারো ব্যাপারে একেবারেই ভুলে যাওয়া কিন্তু ঠিক নয়, অর্থাৎ এ গুলো বিচ্ছিন্না ঘটনা যা আমরা ব্যক্তির উপর দোষারোপ করতে পারি, এজন্য সে দলের সকলের উপর এ দোষ বর্তাবেনা।
মাইকেলঃ অন্য কারন কি?
রাশেদঃ কিছু কিছু কারন আমি উল্লেখ করব, সব গুলো নয়ঃ
সুদূর অতীত থেকেই ইউরোপ কিছু লক্ষ্য উদ্দেশ্যে আরব ও মুসলমানের জন্য সেখানে অভিবাসনের পথ খুলে দিয়েছে। এর মূল কারনের মধ্যেঃ ইউরোপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা, কেননা পাশ্চাত্যের লোকদের জন্ম হার কম হওয়ায় লোকসংখ্যার একটা সমতা আনতে তারা এ কাজটি করে। এটা ইসলামি কৃষ্টি- কালচারকে অনুসরণের জন্য ছিলনা, বরং তাদের ইচ্ছা ছিল মুসলমানেরা লোকসংখ্যা জন্ম দিবে আর সে সব জনবল পঞ্চাশ বছর পরে তাদের সমাজ,সংস্কৃতি ও সভার ধাঁচে গড়ে উঠবে।এমনিভাবেই পাশ্চাত্যের সমাজের কর্ণধারেরা পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু সমাজের এসব কর্ণধারেরা দেখতে পেল যে, ইসলামি নবজাগরণ ইসলামি বিশ্ব থেকে পাশ্চাত্যের বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে পাশ্চাত্য সমাজের সভ্যতার গঠন ব্যবস্থায় অভিবাসী মুসলমান ও তাদের সন্তানেরা বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। মুসলিম বোরকা পরিহিতা নারীরা ও ইসলামী রীতি-নীতি পালনকারী পরিবার অনেকটা আক্রমনের শিকার হল, কেননা তারা তাদের ধর্মীয় আখলাক-চরিত্র, ইসলামি মৌলিক নিয়ম-নীতির উপর চলতে থাকল। আর তারা এটাকেই তারা তাদের সংস্কৃতিকে পূর্নভাবে একীভুত করার পথে প্রতিবন্ধতা হিসেবে বিবেচনা করল।
মুসলিম সন্তানদের এ প্রজন্ম পাপাশ্চাত্যের সমাজ ব্যবস্থার মূল প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সামনে ভিন্ন সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বহনকারী ক্রমবর্ধমান এ জনসংখ্যা এক মহা সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।
অতএব, এ সব উগ্র আক্রমণের মূল কারন হলো পাশ্চাত্যের লোকদের স্বকীয়তা হারানোর ভয়াবহতার উপলব্ধি। এ কারনেই তারা সব ধর্মীয় প্রতীক বা ইসলামী বেশভূষাকে ভীতের কারন মনে করেন। তারা মনে করেন যে, যদি সামান্য বাহ্যিক বেশভূষাকে তারা ছেড়ে দেয় তবে ধীরে ধীরে সমস্ত ইসলামি রীতিনীতি তাদের উপর চলে আসবে। তাই তারা শুরু থেকেই এ গুলোকে নিঃশেষ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে সকল সভ্যতার সঙ্ঘাত এখন ইসলামের সাথে সঙ্ঘাতে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে অন্যান্য আয়োডলজি উহ্য হয়ে থাকে। আর এটাকেই আমেরিকার গবেষক স্যামুয়েল হান্টুন “সভ্যতার সংঘাত” নামে আখ্যায়িত করেছেন, যা পাপাশ্চাত্য সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক মতবাদকে বুঝায়।
মাইকেলঃ আমরা হোটেলে পৌঁছে গেছি, আমরা যে বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছি এ বিষয়ে অনেক আলোচনার দরকার।