আলাহ তায়া’লা যাদেরকে বান্দাহদের কাছে নবী রাসুল করে পাঠিয়েছেন তাদেরকে চেনা ও তাদের সত্যতা প্রমাণের জন্য অবশ্যই কিছু দলিল-প্রমাণ ও লক্ষণ থাকতে হবে। এগুলো প্রমাণ করবে যে, তারা আল্লাহর নিকট থেকে প্রেরিত, যাতে তারা মানুষের বিপক্ষে কিয়ামতের দিনে সাক্ষ্য দিতে পারেন। আর তাদেরকে সত্যায়ণ ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যেন মানুষের কোন ওযর না থাকে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি। (হাদীদঃ ২৫)
নবী রাসুলের সত্যতা প্রমাণে অনেক দলিল প্রমাণ ও আলামত রয়েছে, তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণগুলো হলোঃ
আল্লাহ তায়া’লা নবী রাসুলদেরকে মুজিযা ও নিদর্শন দিয়ে শক্তিশালী করেন। মুজিযা হলো,
আল্লাহ তায়া’লা নবী রাসুলদের মাধ্যমে এমন সব অলৌকিক ঘটনা ঘটান যা বিশ্বের সাধারণ নিয়মের বহির্ভূত ও মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। যেমনঃ মূছা (আঃ) এর লাঠি, যা সাপে পরিণত হত। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ হে মূসা, তোমার ডানহাতে ওটা কি? তিনি বললেনঃ এটা আমার লাঠি, আমি এর উপর ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার ছাগপালের জন্যে বৃক্ষপত্র ঝেড়ে ফেলি এবং এতে আমার অন্যান্য কাজ ও চলে। আল্লাহ বললেনঃ হে মূসা, তুমি ওটা নিক্ষেপ কর। অতঃপর তিনি তা নিক্ষেপ করলেন, অমনি তা সাপ হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল। আল্লাহ বললেনঃ তুমি তাকে ধর এবং ভয় করো না, আমি এখনি একে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব। তোমার হাত বগলে রাখ, তা বের হয়ে আসবে নির্মল উজ্জ্বল হয়ে অন্য এক নিদর্শন রূপে; কোন দোষ ছাড়াই। এটা এজন্যে যে, আমি আমার বিরাট নিদর্শনাবলীর কিছু তোমাকে দেখাই। (ত্বহাঃ ১৭-২৩)
ঈসা (আঃ) এর মু’জিযা ছিল তিনি কুষ্ঠ ও শ্বেত রোগীকে আল্লাহর ইচ্ছায় সুস্থ করতেন। আল্লাহ তায়া’লা মারিয়ামের (আঃ) ভাষায় ঈসা (আঃ) এর জন্মের সুসংবাদ সম্পর্কে এভাবে বলেনঃ তিনি বললেন, পরওয়ারদেগার! কেমন করে আমার সন্তান হবে; আমাকে তো কোন মানুষ স্পর্শ করেনি। বললেন এ ভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যখন কোন কাজ করার জন্য ইচ্ছা করেন তখন বলেন যে, ‘হয়ে যাও’ অমনি তা হয়ে যায়। আর তাকে তিনি শিখিয়ে দেবেন কিতাব, হিকমত, তওরাত, ইঞ্জিল। আর বণী ইসরাঈলদের জন্যে রসূল হিসেবে তাকে মনোনীত করবেন। তিনি বললেন নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। আমি তোমাদের জন্য মাটির দ্বারা পাখীর আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখীতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং শ্বেত কুষ্ঠ রোগীকে। আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। আর আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। আর এটি পূর্ববর্তী কিতাব সমুহকে সত্যায়ন করে, যেমন তওরাত। আর তা এজন্য যাতে তোমাদের জন্য হালাল করে দেই কোন কোন বস্তু যা তোমাদের জন্য হারাম ছিল। আর আমি তোমাদের নিকট এসেছি তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শনসহ। কাজেই আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার অনুসরণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদেরও পালনকর্তা-তাঁর এবাদত কর, এটাই হলো সরল পথ। (আলে ইমরানঃ ৪৭-৫১)
আর মুহাম্মদ (সাঃ) এর সবচেয়ে বড় মুজিযা হলো মহাগ্রন্থ আল কোরআন। যদিও তিনি আক্ষরিক অর্থে নিরক্ষর ছিলেন, লেখাপড়া জানতেননা। অথচ কোরআনের মত মহাগ্রন্থ তিনি আল্লাহর তরফ থেকে নিয়ে আসেন, এটাই তার সবচেয়ে বড় মুজিযা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলুনঃ যদি মানব ও জ্বিন এই কোরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্যে জড়ো হয়, এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না। আমি এই কোরআনে মানুষকে বিভিন্ন উপকার দ্বারা সব রকম বিষয়বস্তু বুঝিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ লোক অস্বীকার না করে থাকেনি। (বনী ইস্রাইলঃ ৮৮-৮৯)
এছাড়াও নবী রাসুলদের অসংখ্য মু’জিযা রয়েছে। নবী রাসুলদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত মু’জিযাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি তিন ধরণের মু’জিযা দান করেছেনঃ জ্ঞান, কুদরত ও সম্পদ। ইলম ও জ্ঞানের মধ্যে রয়েছেঃ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অদৃশ্য সম্পর্কে সংবাদ দেয়া, যেমনঃ ঈসা (আঃ) এর জাতিরা কি খেয়েছে ও কি ঘরে জমা করে রেখেছে তা তিনি বলে দিতে পারতেন। আমাদের রাসুল (সাঃ) পূর্ববর্তী উম্মতের সম্পর্কে নানা সংবাদ দিয়েছেন। তিনি কিয়ামতের আলামত ও ফিতনা সম্পর্কে যে সব সংবাদ দিয়েছেন। কুদরতের মধ্যে রয়েছেঃ লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, কুষ্ঠ ও শ্বেত রোগীকে আরোগ্য করা, মৃত্যুকে জীবিত করা, রাসুল (সাঃ) কে মানুষের সব ধরণের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ হে রসূল, পৌছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না। (মায়েদাঃ ৬৭)
উক্ত তিন ধরণের মু’জিযা – ইলম, কুদরত ও সম্পদ- কোনাটাই আল্লাহর হুকুম ছাড়া সংঘটিত হতনা।
নবীদের নবুয়্যাতের সত্যতার অন্যতম প্রমাণ হলো, পূর্ববর্তী নবীগণ কর্তৃক পরবর্তী নবীগণের আগমনের সুসংবাদ দেওয়া। আল্লাহ তায়া’লা প্রত্যেক নবী রাসুলের থেকে অঙ্গিকার নিয়েছেন যে, মুহাম্মদ (সাঃ) যদি তাদের জীবদ্দশায় প্রেরিত হয় তবে তার উপর ঈমান আনবেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আর আল্লাহ যখন নবীগনের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহন করলেন যে, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান এবং অতঃপর তোমাদের নিকট কোন রসূল আসেন তোমাদের কিতাবকে সত্য বলে দেয়ার জন্য, তখন সে রসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তার সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘তোমার কি অঙ্গীকার করছো এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছ? তারা বললো, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছি’। তিনি বললেন, তাহলে এবার সাক্ষী থাক। আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। (আলে ইমরানঃ ৮১)
নবী রাসুলগণ স্বজাতির সাথে মেলামেশা ও লেনদেন করতেন। এভাবে তারা মানুষকে তাদের জীবনচরিত শিক্ষা দিতেন। তাদের সততা তারা বুঝতে পারত। যখন লোকজন পূতঃপবিত্র মারিয়াম ও তার পুত্র ঈসা (আঃ) সম্পর্কে অপবাদ দিতে লাগল তখন আল্লাহ তায়া’লা তাদের সততা প্রকাশ করেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ অতঃপর তিনি সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলেন। তারা বললঃ হে মারইয়াম, তুমি একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছ। হে হারূণ-ভাগিনী, তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ছিল না ব্যভিচারিনী। অতঃপর তিনি হাতে সন্তানের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারা বললঃ যে কোলের শিশু তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব? সন্তান বললঃ আমি তো আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামায ও যাকাত আদায় করতে। এবং জননীর অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি। আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব। (মারইয়ামঃ ২৭-৩৩)
এভাবেই ঈসা (আঃ) দোলনায় কথা বলেছেন। কুরাইশরা নবুয়াতের পূর্বে মুহাম্মদ (সাঃ) কে তার সততা ও আমানতদারীতার জন্য “আল আমিন” বলে ডাকত, আল কোরআন রাসুলের সত্যতা প্রমাণে এদিকে ইঙ্গিত দিয়েছে। কেননা রাসুলের (সাঃ) জীবন চরিত্রই হলো সবচেয়ে বড় মু’জিযা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলে দাও, যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমি এটি তোমাদের সামনে পড়তাম না, আর নাইবা তিনি তোমাদেরেকে অবহিত করতেন এ সম্পর্কে। কারণ আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না? (ইউনুসঃ ১৬)
নবীদের সত্যতার আরেকটি প্রমাণ হলো সব নবী রাসুলের দাওয়াতের মূল ছিল একই। সব নবী রাসুলগণ তাওহীদের দিকে ডেকেছেন। কেননা ইহাই মানব সৃষ্টির মূল লক্ষ্য, রাসুলদের প্রেরণের উদ্দেশ্য ইহাই। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই এবাদত কর। (আম্বিয়াঃ ২৫)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনার পূর্বে আমি যেসব রসূল প্রেরণ করেছি, তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, দয়াময় আল্লাহ ব্যতীত আমি কি কোন উপাস্য স্থির করেছিলাম এবাদতের জন্যে? (যুখরুফঃ ৪৫)
আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেনঃ আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে আল্লাহ হেদায়েত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেল। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যারোপকারীদের কিরূপ পরিণতি হয়েছে। (নাহলঃ ৩৬)
এদিকেই মুহাম্মদ (সাঃ) তার উম্মতকে ডেকেছেন, রাসুলগণ মানুষের মতই মানুষ, তবে তাদেরকে ওহীর মাধ্যমে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করেছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ বলুনঃ আমি ও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে। (কাহফঃ ১১০)
অতএব, তারা ক্ষমতা বা পদের জন্য লোকদেরকে ডাকতেননা। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমন বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে। আপনি বলে দিনঃ অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা কর না? (আন’আমঃ ৫০)
তারা দাওয়াতের বিনিময়ে লোকদের থেকে কিছুই প্রত্যাশা করতেননা। আল্লাহ তায়া’লা তার নবী নুহ, হুদ, সালেহ, লুত ও শোয়াইব (আঃ) সম্পর্কে বলেন, তারা তাদের জাতিকে বলেছিলেনঃ আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না, আমার প্রতিদান তো বিশ্ব-পালনকর্তাই দেবেন। (শুয়ারাঃ ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪, ১৮০)
মুহাম্মদ (সাঃ) তার জাতিকে বলেছিলেনঃ বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না আর আমি লৌকিকতাকারীও নই। (ছোয়াদঃ ৮৬)
নবী রাসুলদের সত্যতার আরেকটি প্রমাণ হল, আল্লাহ তায়া’লা তাদেরকে সাহায্য করেন ও তিনি নিজেই তাদেরকে হিফাযত করেন। কেননা একজন যদি দাবী করে যে, সে আল্লাহর নবী বা রাসুল আর আল্লাহ পাক যদি তাকে সাহায্য ও হেফাযত না করে তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব! বরং তাদের প্রয়োজনে আল্লাহ তায়া’লা তার আযাব ও শাস্তিও প্রেরণ করেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ তোমাদের মুখ থেকে সাধারনতঃ যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে তেমনি করে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বল না যে, এটা হালাল এবং ওটা হারাম। নিশ্চয় যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করে, তাদের মঙ্গল হবে না। (নাহলঃ ১১৬)
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত, তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা। (আল হাক্কাঃ ৪৪-৪৬)